Wednesday, November 19, 2014

একজন সঞ্জীব চৌধুরী...

তখন বিএনপির দ্বিতীয় শাসন আমল। কারো মুখ খুলবার উপায় নাই। ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছে মানুষ, কেউ মুখ খুলতে পারেনা। বিদ্যুত নাই, মুখ খুলবার উপায় নাই।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর চলছে অত্যাচার। পূর্নিমার কান্নার হাহাকার ভেসে যায় যমুনার জলে। পিতারা বলেন, বাবারা, একজন একজন করে আসো...
কিছু ছেলে, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অকুতোভয় ছেলে আয়োজন করে এক কনসার্টের। ছেলেগুলি গেঞ্জি প্রিন্ট করে। নাম দেয় কনসার্ট ফর ফাইটার্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে, হৃৎপিন্ডস্বরূপ রাজু ভাস্কর্যে। কোন স্পন্সর নেই। ছেলেরা নিজেরাই টাকা তুলে আয়োজন করে। পুলিশি হুমকি কনসার্ট বন্ধ করে দেবার। কোন গায়ক রাজি হন না গান গাইতে।
এগিয়ে এলেন একজন মানুষ। একজন গায়ক। সঞ্জীব চৌধুরী তাঁর নাম। ঝাঁকড়া বাবরি দোলানো চুলে তিনি মাইক্রোফোন হাতে উঠে দাঁড়ান। শুরু করেন গান। চারদিকে পুলিশ ঘিরে রয়েছে। বিএনপি সরকারের পুলিশ।
গান শুরু হলো। চলছে গিটার, চলছে তবলা। আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই... জড়ো হয় মানুষ, জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা। ভরে ওঠে চত্বর।
সঞ্জীব চৌধুরী বলে ওঠেন, এবার আমি বক্তৃতা দেবো। চলছে গিটার, চলছে তবলা। উনি বলেন, "বাংলা ভাই হাঁটে। বাংলা ভাইকে কেউ ধরেনা। আমি যখন বলি, তখন আমাকে ধরে। আমি বলতে চেয়েছিলাম সেই সমস্ত কথা। আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্যত রাইফেল, আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্যত বেয়নেট!"
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই...
অন্ধকার নেমে আসে, অন্ধকার নেমে আসে সারা বাংলাদেশ জুড়ে। য়ার সেই অন্ধকারের ভেতর একজন তাজুল ইসলামকে খুন করা হয়। জানেন, তাজুল ইসলাম কে? ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনোমিক্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কখনো চাকরী নেন নাই। তিনি ছিলেন আদমজীতে। তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। উপপ্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন? আপনাদের কি মনে আছে? নাম বলেন!
মওদুদ আহমেদ! তিনি এখন আইনমন্ত্রী। ঐ ভালো আইন জানেন। জসীমউদ্দীনের মেয়ের জামাই। ভুলে গেছেন সবকিছু? সেই মউদুদ আহমেদ আমাদের আইন শেখায়। আপনারা এখানে বসে বসে আইন শিখবেন। একজন তাজুল ইসলামকে পিটিয়ে মারা হয়, খুন করা হয়। সাক্ষী আদমজী। একজন ভালো মানুষ মাঝরাতে বাড়ি ফিরে এলোনা।
আমি বলতে চেয়েছিলাম সে সমস্ত কথা। তখনই আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্যত রাইফেল। কোথায় আমার বন্ধুরা?
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই...
আমাদের আইনমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীতে শান্তি রক্ষিত হোক। বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীকে ধরিয়ে দিন! আমাকে চুপ করতে হয়, আমাকে চুপ করিয়ে দেয়া হয়।
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই...
একটা ছেঁড়া ছুটকেস থেকে, একটা ছেঁড়া ছুটকেস থেকে ডান্ডি ডাইং হয়ে যায়! বিবেক কি বলে? আপনার বিবেক কি বলে? একটা ছেঁড়া ছুটকেস থেকে ডান্ডি ডাইং হয়ে যায়! বলেন! বলেন!
আরেকজন কর্নেল তাহেরকে বন্দী করা হয়। কে করছিলো? কে করছিলো কর্ণেল তাহেরকে বন্দী? বলেন! চিৎকার করে বলেন। বিবেক দিয়া বলেন। নিজের মায়ের নামে শপথ, নিজের মাটির নামে শপথ, বলেন। বলেন! এই মানুষটিকে কে খুন করছিলো? বলেন!
যদি না বলতে পারেন, আমি গান না গেয়ে এখান থেকে চলে যাবো... বলেন, আমি শুনতে পাই না।
( দর্শকদের ভেতর থেকে চিৎকার ওঠে, জিয়াআআআ, জিয়াআআআ! )
নামটা আবার বলেন!
( সমস্বরে চিৎকার, জিয়াআআআআআআআআআআ )
তাঁদেরকে শোনান, আমার পুলিশ ভাইদেরকে শোনান।
(পুলিশের উদ্দেশ্যে দর্শকদের চিৎকার, জিয়াআআআআ )
আরেকজন কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। আরেকজন বসুনিয়া, অই, অইইই জায়গায়, মুখ থুবড়ে পড়ে যান। আমি কি মিছা কথা কইছি ভাইজান? আমি কি কোন মিছা কথা কইলাম? বলেন? সাক্ষী আমরা সবাই... আমি তো ঐ কথাই কইতে চাইছিলাম...
তখনই, আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্যত বেয়নেট, আমার দিকে এগিয়ে আসে রাইফেল। আমি নাকি বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী। সো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি বলেন? বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীকে ধরিয়ে দিন। আমি নাকি বিশৃংখলাসৃষ্টিকারী!
পৃথিবীতে শান্তি রক্ষিত হোক। আকাশে শান্তি, বাতাসে শান্তি।শান্তি রক্ষিত হোক...
তবু বন্ধুগন, আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই।
[চারপাশে ঘিরে ছিলো বিএনপির পুলিশ]
______________________________________________________
আমাদের একজন সঞ্জীব চৌধুরীর বড় অভাব এই দেশে এখন। অনেক কথাই আমরা জানি, বলতে পারিনা। আমার দিকে ধেয়ে আসবে উদ্যত রাইফেল, উদ্যত বেয়নেট। গুম হয়ে যেতে পারি, এই ভয়ে বলতে পারিনা।
সঞ্জীবদা, আপনার সামনে আমি ছোট হয়ে যাই। আপনার সাহসের কাছে নিজেকে বড্ড ছোট মনে হয়। আমার অপারগতাকে ক্ষমা করবেন।
আমার, স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই...

কৃতজ্ঞতাঃ Mahmudul Haque Munshi

https://www.youtube.com/watch?v=KOa6ov28fzQ

Tuesday, November 18, 2014

মোস্তাকনামা অথবা জনপ্রিয় বাঙালী হওয়ার গোপন রহস্য

খন্দকার মোশতাক আহমেদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিলো তার চোখের পানি। যে কোনো পরিস্থিতিতে কেঁদে ফেলার অপূর্ব ক্ষমতা ছিলো তার। আর এতে অন্যরকম এক মাত্রা পেতো তার অকপট মিথ্যেগুলো। শ্রোতাকে স্পর্শ করতো, তারা আবেগাক্রান্ত হতো। এবং এক পর্যায়ে মোশতাক ভাই বলে জড়িয়ে ধরতো তাকে। আমরা আপনার সঙ্গে আছি মোশতাক ভাই- এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বেরুতো তারা। পরস্পরকে বলতো, মোশতাক ভাই মানুষটা ভালো, বড্ড আবেগী। ইমোশনাল মানুষ। বলতে বলতে তারা ছুরি মেরে যেতো সহযোদ্ধাদের পিঠে। আপাদমস্তক সাইকো মোশতাকের আরেকটি গুণ ছিলো সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা। আওয়ামী লীগের ছোটবড় নেতাকর্মীদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মিশতো। এবং সবার কানেই ঢালতো বিষ। চোখে হানি মুখে বিষ, মোশতাকের গোপন সাধ ছিলো বঙ্গবন্ধুর জায়গা নেওয়া। ইতিহাস বলে সে অনেকখানি সফল হয়েছিলো। আগামসি লেনের নির্জন বাড়িটায় ধুকতে ধুকতে মরার আগ পর্যন্ত তার মনে একটাই প্রশান্তি ছিলো, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলো সে।
হ্যা খন্দকার মোশতাক আহমেদও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ছিলো। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথগ্রহনে স্টেজে ছিলো। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী ছিলো। এবং এই মোশতাক প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভেদ এবং পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস তৈরিতে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছিলো। এতটাই যে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সিংহভাগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে থাকলেও তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্ব মানতে নারাজ হযে পড়েছিলো। তারা মুক্তিযুদ্ধ চায়, তাজউদ্দিনকে চায় না। তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গিয়েছিলো। আর সেই স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগে একঘরে একা হয়ে পড়েছিলেন তাজউদ্দিন। হযরত ওমর (রাঃ)যেমন খালেদ বিন ওয়ালিদকে ডেকে বলেছিলেন,খালেদ তোমাকে আর সিপাহসালার হিসেবে রাখা যাচ্ছে না, লোকে যেভাবে তোমার নাম নিচ্ছে, তোমার বীরত্বের জয়গান গাইছে তাতে তারা আল্লাহকে ভুলে যাচ্ছে…। পিঠে অসংখ্য ছুরি নিয়ে রক্তাক্ত তাজউদ্দিন কোনঠাসা হয়ে পড়ে ছিলেন। সফল হয়েছিলো মোশতাক আহমেদ।
খন্দকার মোশতাক আহমেদও বঙ্গবন্ধুপ্রেমী ছিলো। তার মুখে মুজিব ভাই মুজিব ভাই ফেনাতোলা জপে অভ্যস্ত ছিলো আওয়ামী লিগের নেতাকর্মীরা। ১৪ আগস্ট রাতেও ভাবি আজকে কি রানছেন বলে ৩২ নম্বরের রান্নাঘরে বেগম মুজিবের বেড়ে দেওয়া ভাত তরকারি নোলা ডুবিয়ে খেতে দেখা গেছে। পরদিন একই সময়ে মোশতাক বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। তার জুতোর নিচে বঙ্গবন্ধুর রক্ত। সে রক্ত মাড়িয়ে সে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা দেয়। নিজের আচকান এবং টুপিকে ঘোষণা করে জাতীয় পোষাক হিসেবে। এবং কুলাঙ্গার বাঙালি চেয়ে চেয়ে দেখে যায়, শুনে যায়। আর নিজেকে প্রবোধ দেয় যে ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি। ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার। ক্ষমতায় মোশতাক আহমেদ। এবং কবরে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিন, মুক্তিযুদ্ধের সরকার, মুক্তিযুদ্ধ।
চোখে পানি, মুখে বিষ, আবেগী, ভালো মানুষ। খন্দকার মোশতাকরা বরাবরই জনপ্রিয় এই জাতির কাছে…

কৃতজ্ঞতাঃ অমি রহমান পিয়াল

Monday, November 17, 2014

জ্যাম স্যাটায়ার

কয়েকশ বছর পর মা ছেলেকে গল্প শোনাবে- 'অনেক অনেক দিন আগে, যখন সবার নিজস্ব মিগ-২৯ ছিলো না, হেলিকপ্টারের বদলে রাস্তায় বাস চলতো, তখন এক ছেলে বনানী ফ্লাইওভারের গোড়া থেকে মতিঝিল রওনা দিলো।' ছেলেটির মুখ হা হয়ে যাবে তা শুনে! ভয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।
বাবা ছেলেকে কুমিল্লাগামী একটি বাসে উঠিয়ে দিয়ে সে নিজে মতিঝিল থেকে বনানী যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিআরটিসির বাসে উঠলো। ছেলে কুমিল্লা গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে ফোন দিলো, বাবা, আমি আইসা পড়ছি। তুমি কই? বাবা উত্তর দিলো, ইয়ে, র‍্যাংস ভবনের সামনে! জ্যামে!
আর কয়েকদিন পর সবাই বাসে টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত নিয়ে উঠবে। নীচেরটায় ভাত, মাঝখানের টায় তরকারি, উপরের টায় পাতলা ডাল। ক্যারিয়া বেয়ে বেয়ে ডাল পড়ছে, উপরে লবন খবরের কাগজে মোড়ানো, একটা কাচা মরিচ। শাহবাগ এসে ভাত খাবে সবাই।
প্লেয়িংকার্ড নিয়ে উঠবে। জমজমাট কলব্রিজ টুয়েন্টিনাইন খেলা হবে। সামনে টিভি ফিট করে মুভি ছেড়ে দেয়া যায়। বিআরটিসির মহিলা বাসগুলোতে স্টার জলসা, প্লাস এবং জীবন মানেই জী বাংলা দেখানো হবে (নো অফেন্স!)। গ্রীন লাইনের সাথে কনট্যাক করে স্লিপিং বার্থ এর কয়েকটা ফিট করানো যেতে পারে।
অংক আসবে সৃজনশীল - বিআরটিসির বাসটি বনানীর উদ্দেশ্যে সন্ধ্যা ছয়টায় মতিঝিল থেকে রওনা দিলো। জ্যাম এড়ানোর জন্য সে ইস্কাটনের পাশের রোড দিয়ে ঢুকে বাংলামোটর দিয়ে বনানী পৌছুলো পৌনে নয়টায়। অপর দিকে 'ক' হেঁটে রওনা দিয়ে বনানী পৌছালো আটটায়। শক্তির ব্যয় হিসেব করো।
উত্তর- আমরা জানি, 'ক' হয় স্পাইডারম্যান , নাইলে সুপারম্যান। স্যালুট। আমরা আরও জানি, বিআরটিসির ড্রাইভারটি বুকাচুদা। মেইনরোড ছেড়ে প্যাচাগোচ দিয়ে এরাই ঢুকে।
জ্যাম যখন আরও ভয়াবহ হবে।
মাগরিবের আজানের সময় বাসে উঠা বাসার উদ্দেশ্যে-
হেলপার: স্যার উঠেন, বনানী আসছি।
যাত্রী: ওহ! এশার আজান দিতেছে মনে হয়... সময় মতই আসছি। রাস্তা ফাকা ছিলো?
হেলপার: না স্যার, ফযরের... রাস্তায় জ্যাম ছিলো
যাত্রী: ওহ, তাইলে আর আজ নামবো না, ঐ সাইড থেকে বাসে অফিসের দিকে যাই।
হেলপার: হ
যাত্রী: জোহরের আগে অফিসে যাইতে পারলে হয়
হেলপার: ফি আমানিল্লাহ
যাত্রী: ফি আমানিল্লাহ
যোগ্যতা বিচার হবে এটা দিয়ে-
মেয়ের বাবা: অফিস মতিঝিলে এখন?
ছেলে: হ্যা
মেয়ের বাবা: চাকরি করে আর কত....
ছেলে: চলে যায় আব্বা...
মেয়ের বাবা: হোয়াই আর ইউ কলিং মি আব্বা ?!!
ছেলে: সরি
মেয়ের বাবা: আগে মেয়েকে বিয়ে তো দেই! একটু ধৈর্য ধরো! পরে আব্বা ডাইকো!!!
ছেলে: সরি
মেয়ের বাবা: বাসা কোথায় তোমার ?
ছেলে: বনানী মেস করে থাকি...
মেয়ের বাবা: বনানী থেকে মতিঝিল আসো?
ছেলে: জ্বী
মেয়ের বাবা: বাসে?!
ছেলে: জ্বী বিআরটিসির টায় ওঠার চেষ্টা করি!
মেয়ের বাবা: কল মি আব্বা!
ছেলে: না মানে ইয়ে...
মেয়ের বাবা: যে বনানী থেকে মতিঝিল প্রতিদিন যাতায়াত করতে পারে, সে জীবনে সব করতে পারবে।
ছেলে: থ্যাংক ইউ!
মেয়ের বাবা: সে আব্বা!
ছেলে: আব্বা!
বাসা থেকে ফোন আসবে-
মা: বাবা কুদ্দুস?
কুদ্দুস: জ্বী?
মা: তোর ছেলে হয়েছে!
কুদ্দুস: আলহামদুলিল্লাহ! আমি এখনই আসছি।
অফিস থেকে রওনা দেয়ার পর- রুট মতিঝিল- বনানী
কুদ্দুস: কই, আমার ছেলে কোথায়?
মা: তোর ছেলে স্কুলে গেছে, একটু পরেই চলে আসবে।
কুদ্দুস: অফিসে কাজ ফেলে এসেছি....
মা: এখন যাইছ না, ছেলে কে দেখে যা। নাইলে পরের বার নাতনী সহ ছেলের মুখ দেখতে হবে।

Wednesday, November 12, 2014

ইঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাক্ট

১। তামাম দুনিয়ার ব্যাবাক সাবজেক্ট সোজা খালি ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট বাদ দিয়া।

২। একমাত্র ইঞ্জিনিয়ারদের পক্ষেই সম্ভব সকাল ৮:২৫তে উইঠ্যা সকাল ৮:৩০ টার ক্লাশ করা।

৩। জিন্সের প্যান্ট আর টি শার্ট হইতাছে ইঞ্জিনিয়ারদের জাতীয় পোশাক।

৪। সাধারন মানুষ ভাঙ্গা জিনিস জোড়া দেয়, আর ইঞ্জিনিয়াররা আগে জিনিসটা ভালোভাবে ভাঙ্গে তারপর জোড়া লাগায়।

৫। ইঞ্জিনিয়াররা তৈরি করতে পারে না এমন কিছুই নাই, তারা খালি একটা মাইয়্যার সাথে রিলেশন করতে পারে না এই যা।

৬। দুনিয়ার কোন কিছুর দাম বাড়লেও আমাদের মাথা ব্যাথা নাই। খালি সিগারেটের দাম ৫ টাকা থেকে ৬ টাকা হলেই আমাদের মাথায় আগুন ধরে যায়।

৭। আমরা সমাধান করতে ভালোবাসি, যেখানে কোন সমস্যা নাই ওখানেও আমরা সমস্যা তৈরি করে তারপর সমাধান করি।

৮। যে কোন ইকুয়েশন ডেরাইভ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব। খালি আমাদের কি প্রমান করতে হবে সেই ইকুয়েশন একবার লেইখ্যা দেন।

৯। তুমি কি কপার(CU) আর টেলুরিয়াম (TE) দিয়া তৈরি। কারন তুমি কিউট (CUTE)। এভাবেই ইঞ্জিনিয়াররা ফ্লার্ট করে।

১০। আমাদের জীবনের ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হল টিচার ক্লাশ নিতাছেন কিন্তু এটেন্ডেন্স দিতাছেন না !

১১। আমদের পরীক্ষার আগে একটা রাত টাইম দাও আমরা তোমাকে সিলেবাস শেষ করে দেব।

১২। একজন ইঞ্জিনিয়ারই জানে যে আরেকজন ইঞ্জিনিয়ার কি বা*ডা জানে। কিন্তু সাধারন মানুষ আমাদের জ্ঞানের ঢেকি ভাবে।

১৩। আমরা রাতের বেলা ঘুমাই না আর ভোরবেলা উঠিনা। আমরা ভোরে ঘুমাই আর সন্ধ্যার দিকে উঠি।

১৪| আমরা আমাদের বাপ মায়ের কাছে ধোয়া তুলসি পাতা। ভাজা মাছটাও উল্টায়া খাইতে পারি না। এক পিঠ খায়া রাইখা দিই। ভাবটা এমন, "ও মা !!! ওটা উল্টালেও খাওয়া যায় ???"

১৫| আমাদের সাথে ঝগড়া করা আর গালে বসা মশা মারা একই কথা। কারন মশা মরুক আর না মরুক নিজের গালে থাপ্পর মারতে হবেই।

১৬| প্রত্যেক নতুন Semester আসলে সবার মুখে একটাই হতাশা, এই বছর ও কোন সুন্দর মাইয়্যা ভর্তি হলো না রে পাগলা।

১৭| একটা মাতাল ইঞ্জিনিয়ার যত ভালো ইংলিশ বলতে পারে, আমেরিকানরাও অত ভালো ইংলিশ বলতে পারে কিনা সন্দেহ।

১৮| প্রত্যেক Semester এর শেষে " এই Semesterটা টেনে টুনে পাস করে যাই নেক্সট Semester এ দেখাই দিব আমি কি জিনিস..!" কিন্তু আর দেখানো হয় না কিছুই।

এলোমেলো ভাবনা

জীবনানন্দ দাশ বলে গিয়েছিলো, আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাই না; আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে, পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে। জীবনের বিবিধ অত্যাশ্চর্য সফলতার উত্তেজনা অন্য সবাই বহন করে করুক; আমি প্রয়োজন বোধ করি না আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে নক্ষত্রের নিচে।
আমি বলেছিলাম, তোমাকে অনন্য হতে হবে না এই সমাজের জন্য। যারা সার্টিফিকেট দিয়ে সব যাচাই করে। অদ্ভুত এই দৌড়ে তোমাকে সফল হতে হবে না বোধহয় এই সমাজের জন্য। শুধু জীবন বুঝলেই চলবে। জীবনের প্রতিটা স্তর খুটে খুটে দেখবে। লিফটে তরতর করে উঠে যাওয়াদের দেখে হয়তো হতাশ হবে। কিন্তু পাশের সিঁড়িতে আমি তোমার ওঠার আওয়াজ পাই। প্রতিটা সিঁড়ি ভেঙে তুমি উপরে উঠছো। বন্ধুরা লিফটে আরামে উঠে গেছে, তোমার একটু কষ্ট হচ্ছে এই যা। গন্তব্য ওখানেই, যেখানে তোমার বন্ধুরা আগেই পৌছে গেছে। শুধু সিঁড়ি ভাঙতে হবে, হাল ছাড়া যাবে না। সিঁড়ি ভেঙে যাও। তোমার পায়ের শব্দ যেন না থামে।
ঠিক ওখানটা তেই সে যাবে যেখানটায় তুমি সিএনজি নিয়ে আগে পৌছুবে। প্রথম হবার হাত তালি টা তুমি পাবে জানি। সিএনজির গুমোট পরিবেশে তুমি রিকশায় উঠে বাতাস গায়ে লাগাবার মজা বুঝবে না। তাই প্রথম হবার হাত তালি না পেলেও, রিকশা থেকে নেমে উৎফুল্ল মনে সে তোমার পাশেই দাড়াবো। সে যে প্রথম হবার দৌড়ে অংশ নেয় না, হেঁটে যাবে সে ওখানেই, ঠিক তোমাদের পাশে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় হবার পদক গুলো তোমাদের শো-কেসেই রেখে দিও, তার কাছে থাকুক বিচিত্র এই পৃথিবী তে বিচিত্র ভাবে বেচে থাকার অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতারা, যা তোমাদের পদক গুলো কে অবাক করবে। বেচে থাকতে চায় তারা ভালো লাগা নিয়ে। এটাই বোধহয় জীবন। আর যদি পাশে না দেখতে পাও তাকে , তবে বুঝে নিও পৃথিবী তে নতুন কোন গন্তব্যের সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে প্রথম হওয়াদের আগে কেউ পৌছে গেছে।

Tuesday, November 11, 2014

শিবনারায়ন দাশ - ইনি কে?


লোকে বলে তিনি স্বভাব আঁকিয়ে ছিলেন। উত্তাল সেই সময়ের ছাত্রনেতাও ছিলেন। ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন অংশগ্রহণ করে কারাবরণও করেন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
১৯৭০ সালের ৬ জুন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের ৪০১ নং (উত্তর) কক্ষে তিনি একটি স্বাধীন দেশের স্বপ্নে পতাকার ডিজাইন করেন। এক রাতের ভেতর। সেই রাতেই নিউমার্কেট এলাকার বলাকা বিল্ডিংয়ের ৩ তলার ছাত্রলীগ অফিসের পাশে নিউ পাক ফ্যাশন টেইলার্সের টেইলার্স মাস্টার খালেক মোহাম্মদী পতাকার নকশা বুঝে কাজ শুরু করেন। একটি লাল সবুজের পতকার জন্ম হয়। তার নাম শিব নারায়ন দাশ, কতজন শুনেছি তার নাম? এটি বিশাল প্রশ্ন।
সেই পতকাটি পটূয়া কামরুল হাসান দ্বারা পরিমার্জন হয়েছে, কিন্তু এতে শিবনারায়ন দাসের নামটি কিভাবে যেন হারিয়ে গেলো। নীচের লেখাটি আরেকটি উত্তাল সময়ের। শিব নারায়ন দাস এসেছিলেন সেই উত্তাল শাহবাগে।
নিজের মতো করে লিখে ফেললাম প্রলয় দা। হা, প্রলয় হাসানের সাথে দেখা হয়েছিলো শিব নারায়ন দাশের। বিজ্ঞ প্রলয় চকিতে চিনে ফেললেও পাশ থেকে কেউ প্রলয় হাসান কে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন - 'ইনি কে?' প্রলয় হাসান উত্তর দিলেন- 'ইনি হচ্ছেন শিব নারায়ন দাশ। বাংলাদেশের প্রথম পতাকার ডিজাইনার।' শিব নারায়ন দাশ সেটা শুনে ফেলে ক্ষোভ মিশ্রিত কন্ঠে বল্লেন - 'না না, আমি কেউ না।' প্রলয় হাসান বললেন - 'শিবুদা আমরা জানি আপনার অনেক অভিমান..." তিনি প্রলয় কে থামিয়ে দিয়ে বল্লেন - 'না না, আমার কোন অভিমান নেই। কার উপর অভিমান? কিসের অভিমান?'
গতকাল জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন মারা গেলেন। ১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট এরশাদ যখন জাতীয় স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন, সে অনুষ্ঠানে তাকে আমন্ত্রণ করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় ভিআইপিরা চলে যাওয়ার পর তিনি সেখানে গিয়ে জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন। স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পর কারা যেন বেনামি চিঠি দিয়ে তাকে খুন করতে চেয়েছিল। তারপর পত্রিকায় ইচ্ছা করে তার নাম ভুল লেখা হয়েছিল। নকশার সম্মানী বাবদ ২ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তার আয়কর ধরা হয়েছিল ৫০ শতাংশ, মানে ১ লাখ।
মাইনুল হোসেন মারা গেলেন মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে। শিব নারায়ন দাশ অভিমান নিয়ে নিভৃতে আছেন। হুমায়ন আজাদ সঠিক কথাটি বলেছেন , "বাঙালী জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিণত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে"

File:Flag of Bangladesh (1971).svg
মৃত্যুর পর হয়তো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়া হবে, প্রতিটি মৃত্যুবার্ষীকিতে বিবৃতি, মৃত্যুতে গভীর শোক। আর বেঁচে থাকবে অভাব জরা ব্যধি আর একরাশ অভিমান নিয়ে। অদ্ভুত এক জাতি আমরা। স্মৃতিসৌধ কিংবা জাতীয় পতাকা যারা দিয়ে গেলো, তাদেরকে চিনিই না। অদ্ভুত!

Monday, November 10, 2014

জানলা

জানলা, তুমি বিজ্ঞাপনের মতো,
সুচতুর এক অমোচনের ফাদ। 
জানলা তুমি এঘরে শ্বাশত 
ও ঘরে কার স্বর্নে লুকাও খাদ?

জানলা তুমি বোশেখ মাসের রোদে 
কার বিছানায় হঠাত আগুন জালাও 
জানলা তুমি কিসের প্রতিশোধে 
হাত রেখেও, দরজা দিয়ে পালাও?

জানলা তুমি বিস্মরনের নদী
তোমার দুকুল আকুল করা ডাকে
একটা জীবন গ্রীলেই নিরবধি
অপেক্ষা তার চিবুক তুলে রাখে

জানলা তোমার বুক পকেটে আধার
চিনে নেয়া একটা চিঠি, আশায়
ভুল করে ঠিক সেই চিঠিটাই আবার
ধোপার ঘরে, জলেই দেহ ভাসায়

জানলা তোমার লোহার গারদ চিনে
আটকে দিলাম কাঠের কপাট দুটো
আমিও নিলাম একাকীত্ব কিনে,
ভেসে যাবার জন্যেও খড় কুটো।

৮টি আত্নপীড়ন অথবা কনফেশন ও একটি ফুটনোট

১। 
অজস্র না বলা কথা বলতে চেয়ে বারবার
না বলাই থেকে যায়। মানুষ মাত্রই এক প্রকার
শুদ্ধ যোগফল সমষ্ঠি, এইরুপ বিশুষ্ক হাহাকার।
না বলা সেইসব কথা সকল বন্দী রাখে,
হৃদয় নামের প্রত্নতাত্বিক বায়বীয় কারাগার।
২।
স্বেচ্ছায় বেচে থাকাকে পাশ কাটিয়ে, আফসোস
আমি হতে পারলাম না আদিগন্ত শুন্যতার পর্যটক।
আমি সঠিক পৃথিবীতে, ভুল ভাবে বেচে থাকা সেই প্রতারক ,
কাধে “পাশ কাটাতে না পারা” যার একমাত্র দোষ।

নিদেন পক্ষে এইটুকু নিশ্চই জানেন মহান ইশ্বর কিংবা খোদা,
আমি অচল পয়সা, নিক্ষেপিত থুতু, ডাস্টবিনে ভাংগা থালা ।
আমি সেই পোষ্টবক্স যার বুকে নাই নাগরিক চেতনার তালা।
আমি চোরকেই উদ্দেশ্য করে চিঠি লেখি, আমি সেই বোকা চোদা।

পুনর্বার আফসোস। বুকে বাড়ছে প্রতিনিয়ত দুক্ষ সহ্য করার সাহস।
দুক্ষ, মানুষ হোয়েও মানুষের সাথে আমার এতো অমিল!
তাই নিজের বেচে থাকার আরেক নাম রেখেছি পাপ পঙ্কিল,
পৃথিবীতে আমি মানুষরুপী ইশ্বরের একমাত্র মুদ্রাদোষ।

৩।
আমি জীবিতের বেশে অভিনয় করা মৃত।
আমি ভালোবাসি বার বার হতে,
যাপিত জীবনে ঠিকঠাক কোনো মতে
টেনে টুনে ফেল করা সেই বালক যে পরাজিত।

৪। 
জীবনকে এতোটাই ভালোবাসি, এই গভীর রাতে তাই বুঝি।
মরে যাবার যথেষ্ট কারন থাকা সত্বেও, আমি পরিতাপের
সুযোগ্য, নিবিড় বন্ধু হোয়ে বেচে আছি। না অভাব, না পুজি
সর্বস্ব জীবন নিয়ে, বাহক হোয়েছি হাজারো মনুষ্য অভিশাপের।

সমাজ নির্মিত বিদ্যালয়ে সুদীর্ঘ সময়,
সফল কাটিয়ে আসার পরও সামাজিক
হোতে গিয়ে বুকে ভর করে এক পাহাড় ভয়,
আর অজস্র মনুষ্য কন্ঠে শুনি "ধিক সুমন, ধিক"।

"ধিক্কার" তুমি কালক্রমে হোয়ে উঠো আরো বেশী সামাজিক।
আমি এই যাত্রায় মিথ্যাবাদী রাখাল হোয়ে প্রবেশ করি
সত্যবাদী রাখালদের ক্লাশরুমে।
আমাকে উদাহরনে রেখে শিক্ষকেরা যার যার মতো স্বাভাবিক
সত্য শেখাতে মাথার উপর পাঠ্যসূচীর ছড়ি,
ঘোরাবেই জানি এই শিক্ষাগ্রহন মৌসুমে।

সত্য শেখার পর অজস্র ধিক্কার গায়ে চাপায় বল্লমের সুতীক্ষ্ন সামাজিক ফলা।
আর হোয়ে উঠেনা গল্প বলার ক্লাশে আমার অসামাজিক আত্নজীবনী বলা।

৫।
কারো মনোযোগের কেন্দ্র বিন্দু হতে জন্মাইনি
আমি এ ব্যাপারে শত ভাগ নিশ্চিত। 
শুধু সুপাত্রে কিছু স্মৃতি চিহ্ন রেখে,
কারো মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু থেকে 
সজ্ঞানে তুলে যে নেবোনা এই নিজেকে,
এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে কিঞ্চিত।

৬।
আমি লাষ্ট বেঞ্চ, আমি ব্যাক ডোর
আমি মরে গেলে লাভ হবে তোর।

আমি পাড় মাতালের
জেগে থাকা ভোর।
তন্দ্রার কবিতায় শুন্য আসর।

আমি মরে গেলে লাভ হবে তোর
বিনয়ে বলছি ফের , লাভ হবে তোর
আমি বেচে থাকা মানে গুমোট ফাপড়

৭। 
মন মন্দির
অভিসন্ধির
প্রাচীন জুয়ার কোট
বাঘ বন্দীর।

মন মন্দির
আমার জামায়
দেহ প্রতিদ্বন্ধির।

৮।
সব দেহ সমভাবে পাপ আর পূন্য
প্লাস মাইনাস মেনে ইকুয়াল শুন্য।

** ফুটনোট 
শিকল ও শিকল কাটা করাত
একই লোহা থেকে তৈরি হয়।
শুধুমাত্র আবিষ্কারকের প্রয়োজনে
লোহাদের সম্পর্ক বৈরী হয়।

বেদনা বৃত্ত

১।
বিষদাত আছে জেনেও
যেদিন বাস্তু সাপের মতো
আমাকেও দেবতা ভাবতে
পারবে -
সেদিন তোমার গৃহে প্রবেশ করবো।
নতুবা প্রতিনিয়ত কাউকে হত্যার
হুমকি হোয়ে বেচে থাকার
কি অর্থ আমি জানিনা।
কিন্তু বাস্তু সাপ যদি কাটে
আর মরে যাও
তবে জেনো সে
মৃত্যুর প্রয়োজন ছিলো খুব।
নতুবা মানুষকে ইদুর ভেবে
কোন বোকা চোদা সাপ কামড়ায়?

আর আমরাতো নিরীহ দড়িকেও সাপ ভেবে মুর্ছা যাই ।


২।
বেদনা যখন আমার
সহ্যসীমাকে অতিক্রম
করে যেতে চায়
তখন কি করি?
চোরের মতো
পালিয়ে পালিয়ে
বেচে থাকি
বেদনার চোখ
ফাকি দিয়ে,
এক প্রকার
না থাকার মতোই
খুব সাধারন বা
তারচেয়েও কম
এই বেচে থাকা।

বেদনা ও আমার এই চোর পুলিশ
খেলার অভ্যাস সেই শৈশব থেকেই।
আমার এইটুকু চোর আর
বেদনার ততটুকু পুলিশ হওয়ার
আসলেই প্রয়োজন ছিলো খুব

অনেকে আবার খুব সাধারন
এই বেচে থাকার কাছ থেকে
পালিয়ে বাচে অসাধারন কোনো
বেচে থাকার মোহে বহুমূল্যের
রত্নখচিত পালংক কিনে এনে
তাতে রাখে দেহ, আর তার ঘুম
আসে গিয়ে বেদনার কোলে
সারারাত হেটে হেটে ,
দুহাতে দ্বৈরথ ঘেটে ঘেটে ।

আমার চোর আর বেদনার
পুলিশ হয়ে পালিয়ে বাচার
প্রয়োজন ছিলো খুব।
একথা আমি ও বেদনা দুজনেই
ভালো করে জানি নতুবা আমাদের
দুজনের মধ্যে
যে কেউ অপরজনকে খুন
কোরে তারপর নিজদেহ
সিলিং ফ্যানে ঝুলিয়ে দিতো।


৩ ।
বেচে থাকাটাই রীতি, জ্বালিয়ে বারুদ
স্মৃতি মানে গোপনীয় ঘুমের অষুধ
ঢেলে শিরায় শিরায় গড়া মৃত বুদ বুদ
শোধ করা মৃত দেহে জীবিতের সুদ।

মানবিক বয়েসের আনবিক ভার
দিকে দিকে বাড়ে গাছ উতকন্ঠা
যেখানে সেখানে বাড়ে উটকো পাহাড়
নিয়ে বুকে সাবধানী সতর্ক ঘন্টা

জানি গোল্ডফিশ বোলে কিছু নেই
কাচ যুগ পলাতক স্বচ্ছ্ব বরফে
আজো প্রত্ন তাড়িত কাচ বন্দী মাছেই
গুহার দেয়াল গড়ে প্রাচীন হরফে।


৪।
ধোয়ার সংকেতে লিখি বেদনা অপার
তবু মেঘের পরেই মেঘ, পুনুরাবৃত্তি
কাঠ আনতেই খড় শেষ বারবার
তবু কাঠখড় একসাথে পোড়ানোই রীতি
৫।
শহর ঘুমায় তার নাগরিক বুকে,
চকিদার হুইসেল, সাধু সাবধান
অন্ধবাতাসে কেউ শ্বাস ফেলে ধুকে
অসুখের সুখী মুখ করে সন্ধান

শিরায় শিরায় সুই, উদগ্রীব ধারা
লোহিত রক্তে মেশে বিস্মিত জল
চোখে হেলুসিনশন দেয় কড়া পাহারা
পাহাড়ে শহর যেনো হয়না বদল

হায়রোগ্লিফিক এই শহরের ভাষা
মাটির নীচে খুব বদলায় ধীরে
পূর্ন শরীর পেলে বাড়ে উচ্চাশা
মুখোশে আবৃত মুখ অন্যের শীরে

তোমার জন্য একশ রাতের গল্প জমা

তোমার জন্য একশ রাতের গল্প জমা
কথার পীঠে ভর করেনা ভুল
নীল হলেও রোদ করে দেয় ক্ষমা
তোমার জন্য ফোটা পলাশ ফুল ।

তোমার জন্য জোছনা বিরান রাতে
ঘুমের গল্প কে লিখে যায় একা
বিষন্ন ক্ষন বিষাদ আমার হাতে
শেষ প্রহরে তোমার সাথে দেখা ।

তোমার হাতে স্বপ্ন রঙ্গীন ঘুরি
নীলাভ আকাশ নিরব আহ্বানে
গান শোনাবে ঘুম করে কেউ চুরি
রোদ দুপুরে তোমার কানে কানে ।

বঙ্গবন্ধু: রাজবন্দীর চিঠি… বাজেয়াপ্ত

১৯৫১ সালে কারাগারে রাজবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৫১ সালে কারাগারে রাজবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান
অখন্ড পাকিস্তানের ২৩ বছরের প্রায় অর্ধেকটাই জেলে কেটেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। নির্দিষ্ট করে বললে ১২ বছর, আর দশ বছর কড়া নজরবন্দীতে কাটিয়েছেন এতটাই মাথাব্যথা ছিলেন পাকিস্তান সরকারের, সেটা গণতান্ত্রিক হোক কিংবা সামরিক। এই পোস্টটি তার সেই জেল জীবনের সময়কার কিছু বাছাই চিঠি নিয়ে। রাজবন্দীদের সব চিঠিই সেন্সর হয়। এই সেন্সরশীপের মাত্রা পার হতে না পারলেই সেসব বাজেয়াপ্ত হতো। তারপর জমা পড়তো সরকারী বিশেষ বিভাগের ফাইল ক্যাবিনেটে। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের ফাইলপত্র থেকে উদ্ধার করা এই চিঠিগুলো তুলে দিলাম। এরমধ্যে শুধু একটি চিঠির প্রাপক বঙ্গবন্ধু, যা তার হাতে পৌছেনি, বাকিগুলা তার লেখা যা সরকারী হস্তক্ষেপে প্রাপকের হাতে পৌছেনি।
১১ মার্চ, ১৯৪৮। সচিবালয়ের গেটের সামনে মাটিতে শুয়ে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিব
১১ মার্চ, ১৯৪৮। সচিবালয়ের গেটের সামনে মাটিতে শুয়ে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিব
প্রতিটা চিঠিই স্বকীয়তায় ভাস্বর। নিতান্ত স্বাভাবিক চিঠিও ঐতিহাসিক গুরুত্বের এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্কের ঘনিষ্টতা ও আস্থার মাত্রা সম্পর্কে ধারণা দেয়। পাশাপাশি শেখ মুজিবের কয়েদাবাসের সময়কার মানসিক অবস্থা তুলে ধরে। বাবাকে লেখা চিঠিতে যেমন রাজনীতির প্রতি হতাশা ও ক্ষোভ জানিয়ে তা ত্যাগ করার কথা ভাবছিলেন।একইসঙ্গে মুজিব পরিবারের আর্থিক দৈন্যতারও ইঙ্গিত মিলেছে সেখানে যা তার রাজনীতিরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। চমকপ্রদভাবে এই দেশের সাধারণ মানুষর রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মুজিব বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক অপপ্রচারকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বাস করে অভ্যস্ত। জহুর আহমেদ চৌধুরী, তাজউদ্দিন আহমেদ ও এমএ আজিজের সঙ্গে সম্বোধনের তারতম্যে ফুটে উঠেছে তার সম্পর্কের গভীরতা। খুব কমন এবং ক্যাজুয়াল কথাবার্তা হলেও সহযোদ্ধাদের প্রতি মুজিবের মমতার জায়গাটা লক্ষ্যনীয়। তবে পোস্টের সবচেয়ে চমকপ্রদ উক্তিটা ভাসানীর, যা মুজিবের জেল যাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ২০ বছর পর সত্যিই ফলে গিয়েছিল। ভাসানী লিখেছিলেন: ‘দেশের মুক্তির সঙ্গে তোমার মুক্তি।’ প্রিয় পার্টি সেক্রেটারির প্রতি কি আস্থা রাখতেন ভাসানী তারই প্রমাণ মেলে এই একটা কথাতেই।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে, সবার বাঁয়ে তাজউদ্দিন
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে, সবার বাঁয়ে তাজউদ্দিন
দুটো বাড়তি চিঠি আছে পোস্টের শিরোনামের সঙ্গে সম্পর্কহীন। এর একটি জেল থেকে বেগম মুজিবকে লেখা যা বাজেয়াপ্ত হয়নি, তবে বাবাকে লেখা চিঠিটার সঙ্গে সম্পূরক। আর শেষ চিঠিটি শেখ হাসিনাকে লেখা। গণঅভ্যুথানের পর জেল থেকে বেরিয়ে স্বামীর সঙ্গে প্রবাসী বড়মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন। পাঠকদের সুবিধার জন্য ইমেজ ফাইলের পাশাপাশি চিঠির টেক্সটও তুলে দেওয়া হলো।
বাঁ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু
বাঁ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু
১ম চিঠি: শেখ মুজিবকে মাওলানা ভাসানী, ৩০ এপ্রিল, ১৯৫১
১৮ নং কারকুন বাড়ি লেন
ঢাকা, ৩০-৪-৫১
দোয়াবরেষু,
আমি সর্বদাই গ্রাম অঞ্চলে বাস করি কারণ গ্রামের মরণাপন্ন (চিঠিতে বানান মরণাপন্য) কৃষক-মজুরদের অবস্থা ভাল না হইলে এবং পাকিস্তান শুধু কয়েকজন বড় লোকের নহে। সাড়ে সাতকোটি লোকের পাকিস্তানের উন্নতি স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতি,অনাচার, অবিচার দমনের ব্যবস্থা আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করার দায়িত্ব সকলকেই গ্রহণ করিতে হইবে। প্রাণের চেয়ে প্রিয় জিনিস পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিককে অনুভব করিতে হইবে। তোমার মুক্তির জন্য সরকারের দৃষ্টি বহুবার আকর্ষণ করিয়াছি কিন্তু ছেলে অন্ধ হইলে নাম পদ্মলোচন রাখলে লাভ কি। ধৈর্য্যধারণ করো আল্লাহ তোমার সঙ্গে আছেন।দেশের মুক্তির সঙ্গে তোমার মুক্তি।সরকার অস্থায়ী প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র স্থায়ী এবং আমাদের।আমার দোয়া জানিও এবং সকল বন্দীদিগকে জানাইও।
আবদুল হামিদ খান ভাসানী
Source: Govt. of East Pakistan, Home poll, F/N, 606-48PF, Part-3

১৯৪৯র এই ছবিতে পিতা শেখ লুতফর রহমানে এবং আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হক, ইয়ার মোহাম্মাদ খান। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হয়েই সোজা কর্মীসভায় যাওয়ার জন্য জিপে চড়ে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু
১৯৪৯র এই ছবিতে পিতা শেখ লুতফর রহমানে এবং আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হক, ইয়ার মোহাম্মাদ খান। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হয়েই সোজা কর্মীসভায় যাওয়ার জন্য জিপে চড়ে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু
২য় চিঠি: শেখ লুতফর রহমানকে শেখ মুজিব, ১২ নভেম্বর, ১৯৫৮
রাজনৈতিক বন্দী
ঢাকা জেল
১২-১১-৫৮
আব্বা,
আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল, কারণ এবার তার সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামীও একবার করেছিল। আল্লা আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন বাসায় কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন।বাড়ি যেতে বলে দিতাম।কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই, এবং রাজনীতি আর করবো না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করবো না। যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোনো কাজই করা উচিত না।এ দেশে ত্যাগ আর সাধনার কোনো দামই নাই। যদি কোনদিন জেল হতে বের হতে পারি তবে কোন কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভাল ভাবে সংসার করবো। নিজেও কষ্ট করেছি, আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন। দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভাল আছি।
আপনার স্নেহের
মুজিব
NB: গোপালগঞ্জের বাসাটা ভাড়া দিয়া দেবেন। বাসার আর দরকার হবে না।
মুজিব
Source: Govt. of East Pakistan, Home poll, F/N, 606-48PF, Part-9
প্রসঙ্গক্রমেই এসে পড়ে বেগম ফজিলাতুন্নেসার কাছে লেখা শেখ মুজিবের একটি চিঠি যা সাক্ষ্য দেয় সংসারে টানাটানির। বাবার কাছে পাঠানো (এবং না পৌছানো) চিঠির মাস কয়েক পর এটি লিখেছিলেন তিনি । এ চিঠির আরেকটি নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিটি সন্তানের প্রতি তার পক্ষপাতহীন ভালোবাসা
ঢাকা জেল
১৬-৪-৫৯
রেনু,
আমার ভালোবাসা নিও। ঈদের পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আস নাই। কারণ তুমি ঈদ করো নাই। ছেলেমেয়েরাও করে নাই। খুবই অন্যায় করেছো। ছেলেমেয়েরা ঈদে একটু আনন্দ করতে চায়। কারণ সকলেই করে। তুমি বুঝতে পারো ওরা কতো দুঃখ পেয়েছে। আব্বা ও মা শুনলে খুবই রাগ করবেন। আগামী দেখার সময় ওদের সকলকে নিয়ে আসিও। কেন যে চিন্তা করো বুঝি না। আমার যে কবে মুক্তি হবে তার কোনো ঠিক নাই। তোমার একমাত্র কাজ হবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখানো।টাকার দরকার হলে আব্বাকে লেখিও, কিছু কিছু মাসে মাসে দিতে পারবেন। হাছিনাকে মন দিয়ে পড়তে বলিও। কামালের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল হচ্ছে না। ওকে নিয়ম মতো খেতে বলিও। জামাল যেন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। এবার একটা ছবি একে যেন নিয়ে আসে আমি দেখব। রেহানা খুব দুষ্ট ওকে কিছুদিন পর স্কুলে দিয়ে দিও জামালের সাথে।যদি সময় পাও নিজেও একটু লেখাপড়া করিও। একাকী থাকাতে একটু কষ্ট প্রথম হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে কোন চিন্তা নাই। বসে বসে বই পড়ি। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।
ইতি-
তোমার মুজিব
সূত্র : জাতির জনক প্রকাশনায়-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট, পৃ: ২১০
বাবাকে জেলে দেখেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন মুজিবের চার সন্তান, বা থেকে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ কামাল ও শেখ জামাল
বাবাকে জেলে দেখেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন মুজিবের চার সন্তান, বা থেকে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ কামাল ও শেখ জামাল
৩য় চিঠি: চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী শেখ মুজিব, ৪ আগস্ট, ১৯৬৬
ঢাকা জেল
৪-৮-৬৬
জহুর,
আমার ভালবাসা নিও। কেমন আছ জানি না। তোমার বোধহয় খুব কষ্ট হয়েছে। তোমার বাড়ির খবর কিছু পেয়েছ কিনা জানি না। আমার দিন কোনমতে কেটে যাচ্ছে। আমার জন্য চিন্তা করিও না। আল্লা আমাকে যথেষ্ট সহ্য শক্তি দিয়েছে। তুমি ডিআইবি এসবির কাছে দরখাস্ত করতে পার তোমাকে চট্টগ্রাম পাঠাবার জন্য। কারণ তোমার ছেলেমেয়েদের দেখবার কেহ নাই।চিন্তা করে শরীর খারাপ করিও না। খোদা যাহা করে মানুষের ভালর জন্য করে।
ইতি
তোমার মুজিব
Source: Govt. of East Pakistan, Home poll, F/N, 606-48PF, Part-26

’৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের হওয়ার পর তাজউদ্দিনের সঙ্গে শেখ মুজিব
’৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের হওয়ার পর তাজউদ্দিনের সঙ্গে শেখ মুজিব
৪র্থ চিঠি: তাজউদ্দিন আহমেদকে শেখ মুজিব, ১৯ আগস্ট, ১৯৬৬
ঢাকা জেল
১৯/৮/৬৬ (সিল)
স্নেহের তাজউদ্দিন
আমার স্নেহ ও ভালবাসা নিও। কেমন আছ? খবর জানি না।আমাকে খবর দিও। চিন্তা করিও না। সকলকে সালাম দিও। শরীরটা বেশী ভাল না তবে কেটে যাচ্ছে। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।
ইতি-
তোমার
মুজিব ভাই
Source: Govt. of East Pakistan, Home poll, F/N, 606-48PF, Part-26
৫ম চিঠি: চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজকে শেখ মুজিব, ২৩ আগস্ট, ১৯৬৬
ঢাকা জেল
২৩/৮/৬৬
ভাই আজিজ
কেমন আছ? বহুদিন খবরা পাই না তোমাদের। বন্ধুবান্ধবরা কেমন আছে? শরীরের প্রতি যত্ন নিও কারণ তোমার শরীর ভাল না। আমি কোনো মতে আছি। জেল গেটেই আমার বিচার শুরু হয়েছে, দেখা যাক কি হয়। আল্লা আমাকে যথেষ্ট সহ্য শক্তি দিয়েছে।তোমার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে? সকলকেই ছালাম ও ভালবাসা দিও।
ইতি
তোমার
মুজিব ভাই
Source: Govt. of East Pakistan, Home poll, F/N, 606-48PF, Part-26
বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে দেওয়া চিঠিটা বাদে উপরের সবগুলো চিঠিই বাজেয়াপ্ত। আর শেখ হাসিনাকে লেখা নিচের চিঠিটি জেল থেকে বের হওয়ার পর। ১৩ জুন ১৯৬৯ সালে লেখা। স্রেফ পাঠকের আগ্রহের কথা ভেবে পোস্টে এটি সংযুক্ত:
ঢাকা
১৩-৬-৬৯
হাচু মনি
আমার স্নেহ ও ভালবাসা নিও।ওয়াজেদের চিঠি পেয়েছিলাম, উত্তরও দিয়েছি বোধ হয় পেয়ে থাকবে।জেল থেকে বের হয়ে তোমাকে ভাল করে দেখতেও পারি নাই। শুধু তোমার শরীরে দিকে চেয়ে তোমাকে যেতে দিয়েছি। শরীরের প্রতি যত্ন নিও। ওয়াজেদের শরীর কেমন? আমরা সকলেই ভাল আছি। চিন্তা করে শরীর নষ্ট করিও না। বোধহয় শুনেছ মানিক ভাই (তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক) পিন্ডিতে হঠাৎ মারা গেছেন।বুঝতেই পার আমার অবস্থা। প্রফেসর হাই সাহেবও মারা গিয়েছেন। বাংলাদেশের দুইজন কৃতি সন্তান আমরা হারালাম। চিন্তা করিও না। সুইডেন খুব সুন্দর দেশ। তোমাদের খুব ভাল লাগবে।চিঠি দিও।ভ
তোমার
আব্বা
সূত্র : জাতির জনক প্রকাশনায়-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট, পৃ: ২১১
চিঠির হাইলাইট। বাংলাদেশের দুইজন কৃতিসন্তান, পাকিস্তানের নয়।মনে করিয়ে দিই আবার, সালটা ১৯৬৯।

Thursday, November 6, 2014

প্রেমিক হিসাবে বই পড়ুয়া ছেলেরা ভালো!

প্রেমিক হিসাবে বই পড়ুয়া ছেলেরা ভালো!
ভাবছেন এটা আবার কেমন কথা হলো? আসলেই কিন্তু বিষয়টা ভেবে দেখার মত। হ্যাঁ, আজকাল অনেকেই বই পড়েন না ভুলেও। তবে এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম না, যারা কিনা বইয়ের সাথেই থাকতে ভালোবাসেন। এই বই পড়ুয়া মানুষগুলো কিন্তু বাস্তব জীবনেও অন্যরকম হন। কেমন? এই যেমন বই পড়ুয়া ছেলেরা প্রেমিক হিসাবে চমৎকার হয়ে থাকেন, অন্য যে কোন ছেলের চাইতে ভালো! কিন্তু কেন তাঁরা সেরা? জেনে নিন বই পড়ুয়া প্রেমিকের ১0টি গুণের খবর!
১) তিনি জানেন, তাঁর অভিজ্ঞতা অনেক বেশী
একজন পাঠকের অভিজ্ঞতা অন্য যে কারো চাইতে অনেক বেশী। বইয়ের জগতের মাধ্যমে তিনি রাজপুত্রের জীবন যাপন করেছেন, করেছেন ফকিরের জীবনও যাপন। তিনি জানেন অনেক বেশী, তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাও বেশী। ফলে তিনি শান্ত ও স্থির। হ্যাঁ, সম্পর্কের ক্ষেত্রেও।
২) মাঝপথে পালিয়ে যাবার প্রবণতা তাঁর নেই
একজন পাঠক কখনো বই শেষ না করে ছাড়েন না। আর সেই অভ্যাসটা দেখা যায় তাঁদের জীবনের ক্ষেত্রেও। কাজ হোক বা সম্পর্ক, কোনটাই তাঁরা মাঝপথে ফেলে রেখে পালিয়ে যান না।
৩) তিনি জানেন সমঝোতা করতে
বইয়ের জগতে বসবাস করতে করতে মানুষের জীবনের নানান পরিস্থিতির সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি শিখে ফেলেন জীবনে সমঝোতার গুরুত্ব ও উপায়।
৪) তিনি মেয়েদের সম্পর্কে জানেন ও বোঝেন
পড়ুয়া পুরুষেরা সেই সব ছেলেদের তালিকায় পড়েন না, যারা কিনা শুধু মেয়েদের নিয়ে অলীক কল্পনা করে কাটায়। বরং একজন বই পড়ুয়া পুরুষ মেয়েদেরকে জানেন, বোঝেন, তাঁদের সম্পর্কে ভাবেন এবং তাঁদেরকে দেখেন একদম ভিন্ন চোখে।
৫) তিনি কৌতূহলী
নিঃসন্দেহে পড়ুয়া মানুষেরা কৌতূহলী, আর সে কারণেই তিনি পড়েন। এমন মানুষের সাথে জীবন কখনো একঘেয়ে হয়ে যাবে না, সম্পর্কও না।
৬) প্রথম দর্শনেই তিনি পাগল হন না
একজন ভালো পাঠক জানেন যে প্রথম দর্শনে কোন কিছুকে ভালবাসলে পরে পস্তাতে হয়। জেনে,বুঝে,পড়ে তবেই ভালবাসতে অভ্যস্ত তিনি। আর তাই তিনি যখন আপনাকে ভালবাসবেন, জেনে নেবেন যে কাজটা তিনি জেনে-বুঝেই করছেন।
৭) তাঁর আদর্শ অন্যদের চাইতে উন্নত
একজন বই পড়ুয়া মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের মানুষ তাঁকে অন্যদের চাইতে উন্নত মানুষ হতে সহায়তা করে। স্বভাবতই মানুষ হিসাবে তিনি আদর্শগত দিক থেকে অনেকটাই উন্নত হয়ে ওঠেন। এমন একজন রুচিশীল মানুষের সাথে জীবনটা হয়ে উঠবে সুন্দর।
৮) তিনি চাকচিক্যে ভোলেন না
একজন ভালো পাঠক কেবল বইয়ের মলাট দেখেই ভালোমন্দ বিচার করেন না। আর এই অভ্যাস তাঁর বাস্তব জীবনেও রয়ে যায়। কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে তিনি ভোলেন না, তিনি জানেন সনাতনের গুরুত্ব। সব নতুনই যে ভালো নয়, চকচক করলেই যে সোনা হয় না ইত্যাদি তিনি ভালোই বোঝেন।
৯) তিনি পুরনোকে ভয় পান না, ভালোবাসেন
সম্পর্ক পুরনো হয়ে যাওয়া যে কোন মানুষের বড় ভয়। কিন্তু পড়ুয়া পুরুষদের এটা নেই। পুরনো বইয়ের মতই তাঁরা পুরনো প্রেমিকা ও পুরনো সম্পর্কের কদর করেন।
১০) তিনি জানেন কীভাবে বুঝে নিতে হয়
মনে কথা বুঝতে পারার গুণটি ভালো পাঠক মাত্রই আছে। আর এই গুণ যখন প্রেমিকের মাঝে থাকবে, ভাবুন তো জীবনটা কত সহজ হবে।

একাত্তরের রাজপুত্রেরা

একাত্তরের রাজপুত্রেরা
…আমি ছেলেটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। সদ্য তরুণ। কলেজে পড়ে। হাতের একনলা বন্দুকটির নল মরচেধরা। বুকে আড়াআড়ি বাধা ছেড়া চামড়ার স্ট্রিপ তাতে কিছু আদ্যিকালের কার্টিজ, ফুটবে কিনা সন্দেহ!ছেলেটা যুদ্ধ করতে এসেছে। বললাম, তুমি এই বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করবে! পাকিস্তানীদের মারবে!ছেলেটা আমার চেয়ে অবাক মুখভঙ্গী করে বললো, ক্যানো স্যার, এই বন্দুক দিয়ে আমার দাদা যদি বাঘ শিকার করতে পারেন, আমি মানুষ মারতে পারবো না! (এক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা)…
ঘটনাটা বললাম সে সময়কার তরুণদের মনোভাবটা বোঝাতে। আজ ফেসবুকে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের ক্যাজুয়ালটির একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলাম।https://www.facebook.com/notes/mehedi-sultan/979836922042302 আর সেই সংখ্যাটা দেখে অনেকে হয়তো বিস্মিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে এত বিশাল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার হাতে যদি মাত্র হাজার চারেক পাকিস্তানী নিহত হয় তাহলে কি যুদ্ধ করেছেন তারা! এই বিস্ময় আসলে এসেছে কনভেনশনাল বা প্রথাগত যুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে যেখানে শুধু স্থলেই না, আকাশ জল এমনকি অন্তরীক্ষেও (স্যাটেলাইট) লড়াই চলে। একদল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী যেখানে অবস্থান নেয় সেটার সুরক্ষা তারা নিশ্চিত করে দূর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে। থ্রি নট থ্রি নিয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধার কোনো পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করার কল্পনা খুব একটা বাস্তবসম্মত না। যেখানে তাদের কারও ছোড়া প্রথম গুলিটাই প্রতিপক্ষকে অবস্থান জানিয়ে দেবে এবং নিরাপদ বলয়ে বসে তার দিকে ছোড়া হবে অজস্র তপ্তসীসা। এধরণের আক্রমণে এয়ারসাপোর্ট ও আর্টিলারি ব্যাকাপের পাশাপাশি ভারী অস্ত্র থাকা খুব জরুরী। আফসোস বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সেই বিলাসিতার সুযোগ ছিলো না। প্রতিটি গুলি তারা হিসেব করে খরচ করেছেন, করতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ সেটা প্রতিপক্ষের মৃত্যুই শুধু নয় তার নিজের জীবনেরও রক্ষাকবচ। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কোনো অবাস্তব মিথ তৈরির অপচেষ্টা না করে বরং জানা যাক তাদের সম্পর্কে জানা অজানা কিছু তথ্য।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানী একবার কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো গণহত্যায় নামা। তারা যদি রাজনৈতিক নেতা বা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই তাদের অভিযান সীমাবদ্ধ রাখতো তাহলে হয়তো সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনীর বাঙালী অফিসার ও সৈন্যরা চুপ থাকতেন। কিন্তু সাধারণ বাঙালীদেরও যখন রেহাই দেওয়া হলো না, শিক্ষক বুদ্ধিজীবিদেরও যখন হত্যা করা হলো, তখন সব শ্রেণীর মানুষই যুদ্ধে নেমে গেলো।’ বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তানীদের পরিকল্পনাই ছিলো তা। নির্মম গনহত্যার মাধ্যমে বাঙালীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ভুলিয়ে দেওয়া। সেই হত্যার প্রতিরোধ,প্রতিশোধই মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে আগুন ধরিয়ে তাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সামিল করেছে। ওসমানীর ভাষায়, ‘পাকিস্তানীরাই প্রতিদিন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করছিলো।’
মুক্তিযুদ্ধের একদম বেসিক ছবিটা তার আগে তুলে ধরা দরকার।মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানের নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই বাংলাদেশ সরকার ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরে আত্মপ্রকাশ করে। এবং সেই সরকার ১০ এপ্রিল প্রকাশিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে জানান দেয় ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এই সরকার কার্যকর। এই সরকার কোনো সামরিক সরকার নয়, বরং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার। এই সরকারের নেতৃত্বে এবং তত্বাবধানে ও নির্দেশনাতেই সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, পুলিশ, আনসার এবং গণবাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিত রূপে মুক্তিবাহিনী হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সারা বিশ্বজুড়ে এই সরকারই স্বীকৃতি পেয়েছে। এবং পাকিস্তানী কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু এই সরকারের কাঠামোতেই রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
তবে যতো উদ্দীপনা থাক, দেশপ্রেম থাক এবং প্রতিশোধের আগুন যতোই দাউদাউ জ্বলুক বন্দুক চালাতে না জানলে বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। ঠিক মতো বন্দুক ধরে তাদিয়ে গুলি ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করার মিনিমাম প্রশিক্ষণটা জরুরী। হাজার হাজার যুবক প্রতিদিন সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতে যাচ্ছিলো সেই প্রশিক্ষণ নিতেই। আর তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলো ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে বিএসএফই প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য ব্যাপারে সহায়তা দিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী নয়। মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন ৩০ এপ্রিল ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অন্যদিকে এক সাক্ষাতকারে লে. জেনারেল বি.এন. সরকার জানিয়েছেন ৯ মে ভারতীয় সেনাপ্রধান তাকে ডেকে বলেন যে ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্রিগেডিয়ার, লে.কর্ণেল এবং মেজর পর্যায়ের কিছু অফিসারকে জরুরী ভিত্তিতে পূর্বফ্রন্টে নিয়ে আসতে হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড জিওসি-ইন-সির অধীনে আগস্টের শুরুতে মুক্তিবাহিনীর অপারেশনাল ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। তার আগে এই দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল ও. এস কালকাট।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর আমাদের নির্ভরতা ছিলো। কিন্তু তার মানে এই না আমাদের ছেলেরা দলে দলে গিয়ে বলেছে আমাদের বাচাও, পাকিস্তানীরা আমাদের মেরে ফেলছে। বরং তারা গিয়ে বলেছে আমাদের তোমরা অস্ত্র দাও। আমরা আমাদের দেশটাকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করতে চাই। ভারতীয়রা তাদের অস্ত্র দিয়েছে, কিভাবে সেই অস্ত্র চালাতে হয় শিখিয়ে দিয়েছে। আর শিখিয়েছে যুদ্ধের কিছু বেসিক যা না জানলেই নয়। লি এনফিল্ড, মার্ক থ্রি রাইফেল, ব্রিটিশ কারবাইন আর এলএমজি ও কিছু গ্রেনেড নিয়েই দেশ মুক্তিতে নেমে গিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধারা।
তারপরও এই যুদ্ধে তুলনামূলক গুরুত্ব ছিলো নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের। কারণ তারা ছিলেন প্রশিক্ষিত। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকের। এদের মধ্যে সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে ৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের একটা রূপরেখা তৈরি করতে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে এক বৈঠক করেন ওসমানী। জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, শফিউল্লাহসহ ছোটবড় ২৭জন অফিসার ছিলেন। সেখানেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়, যার মধ্যে প্রধান ছিলো:১. বিশাল একটি গেরিলা যোদ্ধাদল তৈরি করে অন্তর্ঘাত চালাতে হবে যাদের কাজ পাকিস্তানীদের দালালদের হত্যা করা, বিভিন্ন স্থাপনা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করার মাধ্যমে পাকিস্তানীদের চলাফেরায় অচলাবস্থা তৈরি করা। হিট অ্যান্ড রান টেকনিকের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানীদের বিভিন্ন পোস্ট এবং গাড়ি বহরে হামলা চালাবে। এবং এর মাধ্যমে পাকিস্তানীরা সবসময় স্নায়ুচাপে ভুগবে। ২.অস্ত্র চালাতে সক্ষম আধাসামরিক বাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন সেক্টরে সেক্টরফোর্স সদস্য হিসেবে সন্নিবেশিত করা হবে এবং তারা এই গেরিলাদের সশস্ত্র সহায়তা দিবে। ৩.নিয়মিত বাহিনী ও গেরিলাদের মধ্য থেকে যোগ্যদের বাছাই করে এবং তাদের প্রশিক্ষন দিয়ে সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে যারা পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে যাবে।মানে মুখোমুখি লড়াইয়ে নামবে।
১১ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন কমান্ডারদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসে। সেই সম্মেলনে যেসব বিষয় নির্ধারিত হয় তার মধ্যে প্রাসঙ্গিকগুলো ছিলো: ১.বাংলাদেশকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে যুদ্ধ পরিচালিত হবে।২.গেরিলা যুদ্ধকে সমন্বিত করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়: ক. নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে প্রশিক্ষিত গেরিলাদের ৫ কিংবা ১০ জনের দলে ভাগ করে দেশের ভেতরে পাঠানো হবে খ.গেরিলাদের দুই ভাগে ভাগ করা হবে এক. অ্যাকশন গ্রুপ : যারা শত্রুদের উপর আক্রমন করবে এবং তাদের পঞ্চাশ থেকে শতভাগ সশস্ত্র হবে দুই.ইনটেলিজেন্স গ্রুপ : যারা সংঘাত এড়িয়ে শত্রুদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করবে এবং সেসব তথ্য মিত্রদের কাছে সরবরাহ করবে। এদের তিরিশভাগকে সশস্ত্র করা হবে। তিন. গেরিলা বেজ: স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার তত্বাবধানে কয়েকটি সেফ হাউজ চিহ্নিত করে তা গেরিলাদের আবাসন ও আশ্রয়ের জন্য ব্যবহার করা হবে যেখানে মেডিকেল সুবিধা থাকবে। ৩, নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ব্যাটেলিয়ান গড়ে তোলা হবে এবং আধাসামরিক ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গড়া হবে সেক্টর ফোর্স যার অপর নাম স্বাধীন বাংলা রেজিমেন্ট। ৪. সামরিক কর্মকান্ডের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়:ক. গেরিলাদের একটি বিশাল বাহিনীকে দেশের ভেতর পাঠিয়ে শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে হবে। তাদের উপর নিয়মিত অ্যামবুশ ও চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে হবে। খ. কোনো কলকারখানা চালাতে দেওয়া হবে না। বিদ্যুতের খুটি ও পাওয়ার স্টেশনগুলোতে বোমা হামলা চালিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা বিঘ্নিত করা হবে। গ.প্রতিটি গুদামে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দিতে হবে যাতে পাকিস্তানীরা কোনো পন্য রপ্তানী করতে না পারে।ঘ. পাকিস্তানী সেনাদের ও তাদের রসদ বহনে ব্যবহার্য যানবাহন, নৌযান, রেলগাড়ি ধ্বংস করে দিতে হবে। ঙ, যুদ্ধপরিকল্পনা এমন ভাবে করতে হবে যাতে শত্রু ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। চ. তাদের বিচ্ছিন্ন করার পর গেরিলা দলগুলো তাদের উপর মারণঘাতি হামলা চালাবে। জুলাইয়ের সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার দেশের রণাঙ্গণকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে। এগুলো হচ্ছে:১ নং সেক্টর:চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালির কিছুটা (মুহুরি নদীর পূর্বতীর)নিয়ে গঠিত এই সেক্টর বিভক্ত ছিলো ৫টি সাব-সেক্টরে। প্রায় ২১০০ জনের সেক্টর ফোর্সে দেড় হাজার ছিলেন ইপিআর বাহিনীর সদস্য, ২০০ পুলিশ এবং ৩০০ সেনাসদস্য আর বাকিরা নৌ ও বিমান বাহিনীর। এর বাইরে ২০ হাজারের বেশী বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন যাদের মাত্র ৩৫ ভাগ সশস্ত্র ছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমান এই সেক্টরের প্রথম অধিনায়ক, পরে তার জায়গা নেন মেজর রফিকুল ইসলাম। ২ নং সেক্টর:কুমিল্লা, ফরিদপুর, নোয়াখালির কিয়দাংশ ও ঢাকা নিয়ে গঠিত এই সেক্টর বিভক্ত ছিলো আরও ৬টি সাবসেক্টরে। ৪ হাজার সেক্টর সেনা এবং ৩০ হাজার গেরিলার এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর খালেদ মোশররফ, পরে নেতৃত্ব দেন মেজর হায়দার। ৩ নং সেক্টর:মৌলভীবাজার ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কিছু অংশ নারায়ণগঞ্জ এবং কেরানিগঞ্জের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এই সেক্টরে ছিলো দশটি সাবসেক্টর এবং যোদ্ধা ছিলো প্রায় দশ হাজার। মেজর শফিউল্লার এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন পরে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এস ফোর্সের নেতৃত্ব দেওয়া হলে শফিউল্লাহর জায়গা নেন মেজর নুরুজ্জামান। ৪ নং সেক্টর:উত্তরে সিলেট পুলিশ স্টেশন এবং দক্ষিণে হবিগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের মাঝামাঝি অবস্থিত এই সেক্টরের ছিলো ছয়টি সাবসেক্টর।৩ হাজার সেক্টর ট্রুপস আর ৮ হাজার গেরিলার যুদ্ধস্থল এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। এই সেক্টরের সদরদফতর প্রথমে রাণীগঞ্জে ছিলো, পরে তা মাসিমপুরে স্থানান্তরিত হয়।৫ নং সেক্টর:সিলেটের উত্তরাঞ্চলে ছয়টি উপসেক্টর নিয়ে গঠিত এই সেক্টরে ছিলো ৮০০ সেক্টর ট্রুপস এবং ৭ হাজার গেরিলা। অধিনায়ক ছিলেন মীর শওকত আলী। ৬ নং সেক্টর: রংপুর দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন উইং কমান্ডার এমকে বাশার। ৫টি সাবসেক্টরে বিভক্ত এই সেক্টরে নিয়মিত বাহিনী ছিলো ১২০০ জনের এবং গেরিলা ছয় হাজার। পাটগ্রামের বুড়িমারি ছিলো এই সেক্টরের সদরদফতর। ৭ নং সেক্টর:রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া এবং দিনাজপুরের কিয়দাংশ নিয়ে গঠিত এই সেক্টর ভাগ ছিলো ৮টি উপসেক্টরে। নিয়মিত বাহিনীর দু হাজার এবং সমসংখ্যক গেরিলার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর নাজমুল হক। এক গাড়ি দূর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর তার জায়গা নেন মেজর কাজী নুরুজ্জামান।৮ নং সেক্টর:কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল পটুয়াখালি নিয়ে প্রাথমিকভাবে গঠিত এই সেক্টর থেকে পরে বরিশাল পটুয়াখালিকে আলাদা করে দেওয়া হয়। ৭টি উপসেক্টরে বিভক্ত এই সেক্টরের সদর ছিলো বেনাপোলে। ২ হাজার সেক্টরফোর্স এবং ৭ হাজার গেরিলার এই রণাঙ্গনে প্রথমে অধিনায়ক ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। ১৫ জুলাই মেজর এমএ মঞ্জুর এর দায়িত্ব নেন এবং ওসমান চৌধুরীকে সদর দফতরে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৯ নং সেক্টর:বরিশাল, পটুয়াখালি এবং ফরিদপুর-খুলনার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের অধীনে ছিলো এক ব্যাটেলিয়ান নিয়মিত সেনা এবং ১৫ হাজার গেরিলা। ৭ টি সাবসেক্টরে বিভক্ত ছিলো এটি যার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর এমএ জলিল।
১০ নং সেক্টর:এই সেক্টরের কোনো সীমারেখা ছিলো না। পাকিস্তানী নৌযানগুলোর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত চালাতে নৌ কমান্ডোরা এই সেক্টরে অপারেশন চালাতেন। নির্দিষ্ট অপারেশনে ওই এলাকার নির্ধারিত সেক্টর কমান্ডারের অধীনস্থ হতেন তারা।
১১ নং সেক্টর: বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা জুড়ে বিস্তৃত এই সেক্টর ভাগ ছিলো ৮ ভাগে যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর আবু তাহের। তার অধীনে ছিলো ২০ হাজার গেরিলা। ১৫ নভেম্বর কামালপুরের যুদ্ধে তাহের আহত হলে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ তার জায়গা নেন।
যেহেতু অস্ত্র ও সাপ্লাইয়ের জন্য ভারতীয় বাহিনীর উপর নির্ভরশীল ছিলো মুক্তিবাহিনী, তাই এটি সুচারুভাবে সারতে প্রতিটি সেক্টরে বাংলাদেশের পাশাপাশি একজন ভারতীয় সেক্টর কমান্ডারও ছিলেন বিএসএফের প্রতিনিধি। তার মাধ্যমেই ভারতীয় বাহিনীর কাছে সাপ্লাই, রেশন এবং অ্যামুনেশনের জন্য আবেদন করতেন বাংলাদেশী সেক্টর কমান্ডার। ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের কমান্ডের অধীনে ছিলো বাংলাদেশের এই ১১টি সেক্টর যা তারা ছয়জন ব্রিগেডিয়ারের অধীনে ভাগ করেছিলো ৬টি জ্যাকপট সেক্টরে। মুক্তিবাহিনীর এক বা একাধিক সেক্টরের প্রশাসনিক এবং অপারেশনের নিয়ন্ত্রণ ছিলো এই জ্যাকপট কমান্ডারদের হাতে। তবে প্রতিটি সেক্টরের যুদ্ধপরিকল্পনা ভারত এককভাবে নিতে পারতো না, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরের সঙ্গে আলোচনা করেই তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আসতে হতো যা বাস্তবায়ন করতেন সেক্টর কমান্ডাররা। আর সেটা তত্বাবধান করতেন জ্যাকপট সেক্টর কমান্ডাররা। ইংরেজি বর্ণমালার এ থেকে এফ পর্যন্ত নামাংকিত এইসব জ্যাকপট সেক্টর দেখতেন ভারতীয় বাহিনীর যেসব অফিসার, তাদের নাম উল্লেখ করছি:১.ব্রিগেডিয়ার জে.সি যোশীর অধীনে ছিলো মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর সেক্টর।২. ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং নিয়ন্ত্রণ করতেন ৭ নম্বর সেক্টরের যুদ্ধ।৩.ব্রিগেডিয়ার এন.এ.সালিক ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের দেখভাল করতেন। ৪.ব্রিগেডিয়ার শাবেগ সিংয়ের নিয়ন্ত্রণে ছিলো ১,২ ও ৩ নম্বর সেক্টর।৫.ব্রিগেডিয়ার এম.বি.ওয়াড়কে দেখতেন ৪ নম্বর সেক্টর, তার ই সেক্টরকে ই-ওয়ান নামে বিভক্ত করে ৫ নম্বর সেক্টর দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো লে.কর্নেল ভিএন রাওকে এবং পরে সে দায়িত্ব পালন করেন ব্রিগেডিয়ার কে লাখপত সিং।৬.ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংয়ের অধীনে ছিলো ১১ নম্বর সেক্টর।
২৫টি যুব ক্যাম্পের মাধ্যমে আগ্রহীদের মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করা হতো। ১হাজার তরুণ যুবকের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এসব ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলো ভারতীয় পুনর্বাসন মন্ত্রনালয়। এদের মধ্য থেকে রাজনৈতিক আনুগত্য যাচাই বাছাই করে তারপর তাদের নেওয়া হতো। প্রচুর পরিশ্রম, মানসিক বিপর্যস্ততা, পারিবারিক সমস্যার কারণে কিছু ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষন ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা আছে। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে শরণার্থী শিবিরের সক্ষম তরুণ যুবকদের যুদ্ধে অনাগ্রহ। লাখখানেক মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে শরণার্থী শিবির থেকে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার শতকরা হারটি লজ্জাজনকভাবে এক ভাগেরও কম। আবার দেশ থেকে অনেক দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ক্যাম্পে এসেও প্রশিক্ষণের জন্য সুযোগ পাচ্ছিলেন না অনেক বাঙালী তরুন। আগরতলা ক্যাম্পে এমন একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে তিন হাজার তরুণ সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য দুমাস ধরে অপেক্ষায় আছেন মানবেতর পরিবেশে। আরেকটি সমস্যা ছিলো ছাত্রদের মধ্যে। রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন এই ছাত্ররা একেকজন মাও সেতুং কিংবা চে গুয়েভারা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকলেও বাস্তবতা তাদেরকে নাড়া দিয়ে যায়। একেকজনের রাজনৈতিক আনুগত্যের বিভিন্নতাও সমস্যা সৃষ্টি করে যখন একজন আরেকজনের নেতৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের কঠোর হস্তক্ষেপে অবশ্য এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।সে তুলনায় চাষাভুষা গ্রামের সাধারণ ছেলেরা অনেক বেশী ঝামেলাহীন। তারা রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া করেনি, জাঙ্গলবুটের জন্য ঝগড়া করেনি। ছেড়া গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি মালকোচা মেরে জয় বাংলা বলে যুদ্ধ করে গেছে।
প্রাথমিকভাবে ভারত ছয়টি প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে ছয় জ্যাকপট কমান্ডারের তত্বাবধানে। এগুলো ছিলো মুরতি (পশ্চিমবঙ্গ), রায়গঞ্জ(পশ্চিমবঙ্গ), চাকুল্য(বিহার) ,দেওটামুরা (ত্রিপুরা), মাসিমপুর (আসাম), তুরা (মেঘালয়)। এসব ক্যাম্প থেকে প্রতিমাসে ১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হতেন। পাশাপাশি ই-ওয়ান সেক্টরের অধীনে ছিলো ঝারিনপুর (মেঘালয়) যেখান থেকে বের হতেন ৫০০ জন। প্রতি ১০০জন প্রশিক্ষনার্থীর জন্য ছিলেন একজন অফিসার, ২জন জেসিও এবং ৫ জন ননকমিশনড অফিসার। চার সপ্তাহের এই প্রশিক্ষণে অস্ত্র চালনার পাশাপাশি, রেকি, এমবুশ, বুবি ট্র্যাপ এবং রেডিও সিগনাল পাঠানো শেখানো হতো। আগস্ট মাসে এই প্রশিক্ষণের সময়সীমা কমিয়ে তিন সপ্তাহ করা হয়।
নভেম্বরের শেষ দিকে যখন বাংলাদেশ ভারত যৌথ বাহিনী গঠন করা হচ্ছে তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা প্রায় ৮৩ হাজার আর তাদের মধ্যে ৫১ হাজারই দেশের ভেতরে যুদ্ধ করছেন। একশো থেকে দেড়শো জন নিয়ে গঠিত হতো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ। তাদের বিশজনের স্কোয়াড এবং দশজনের টিমে বিন্যস্ত করা হতো। প্রতি টিমে থাকতো চারটি থ্রিনটথ্রি রাইফেল, দুটো এসএলআর, তিনটি স্টেনগান এবং একটি এলএমজি। প্রতি মুক্তিযোদ্ধা মাথা পিছু দুটো করে গ্রেনেড পেতেন এবং পর্যাপ্ত বিস্ফোরক। মুরতি ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বা স্বাধীন বাংলা রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাচের ১৩০ জন ক্যাডেট অফিসারকে তিন মাসের ট্রেনিং দেওয়া হয় যাদের অন্যতম ছিলেন শেখ কামাল। এছাড়াও ৫০০ জন যুবককে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যাতে তারা নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম হয় যুদ্ধে আগ্রহী কিন্তু ভারতে আসতে না পারা তরুণদের। এর বাইরে ১২০০ যুবককে মেডিকেল ট্রেনিং দিয়ে মেডিকেল কিটসহ পাঠানো হয় দেশে।
এখানে মনে রাখতে হবে গণবাহিনীর সদস্য বা বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন একধরণের স্বেচ্ছাসেবক। কিন্তু নিয়মিত এবং আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন পেশাদার। তাই তাদের জন্য বেতন বরাদ্দ ছিলো বাংলাদেশ সরকারের তরফে। জ্যাকপট কমান্ডারের মাধ্যমে প্রতিমাসে এই বেতন পেতেন তারা যা ছিলো এরকম:কমান্ডিং অফিসার : ৫০০ ভারতীয় রুপিঅফিসার: ৪০০ রুপিঅফিসার ক্যাডেট: ১০০ রুপিজুনিয়র কমিশনড অফিসার (জেসিও): ১৫০ রুপিমুক্তিফৌজের নন কমিশনড অফিসার এবং নিয়মিত বাহিনীর সাধারণ সৈন্যদের বেতন ছিলো যথাক্রমে ৭০ ও ৭৫ রুপি।অন্যদিকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ কালে ৩০ রুপি এবং ট্রেনিং শেষে ৫০ রুপির এককালীন ভাতা পেতেন। দেশে পাঠানোর সময় দিন হিসাব করে তাদের জন্য বরাদ্দ ছিলো প্রতিদিন ২ রুপি।বেতনের পাশাপাশি দুই সেট খাকি ইউনিফর্ম এবং হালকা বিছানা পেতেন নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা। আধাসামরিক বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা পেতেন লুঙ্গি, শার্ট, পিটি স্যু। এর বাইরে স্থানীয় সূত্র থেকে কম্বলসহ থালাবাসন ইত্যাদি জোগাড় করে নিতেন তারা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতো একই রেশন বরাদ্দ ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অনুযায়ী অস্ত্রের সংখ্যা ছিলো অপ্রতুল। এই সমস্যার কারণ হচ্ছে ভারতীয় বাহিনীর অর্ডন্যান্স থেকে এসব অস্ত্র ইস্যু করে তারপর আকাশপথে নিয়ে যেতে হতো প্রয়োজনীয় জায়গায়।সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক এই জটিলতায় হতাশায় ভুগতে হতো মুক্তিযোদ্ধাদের।
বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো ভাগ ছিলো যাদের মধ্যে ব্যতিক্রমী কিছু হচ্ছে: 
  1. সুইসাইড স্কোয়াড:মূলত জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম লীগের দালাল নেতাদের হত্যা করাই ছিলো এদের মিশন। পাশাপাশি রাজাকার এবং পাকিস্তানীদের সহযোগী দালাল বাঙালী কর্মকর্তারাও ছিলো তাদের হত্যা তালিকায়। এদের উপর নির্দেশনা থাকতো গ্রেফতার এড়াতে আত্মহত্যার। 
  2. বিচ্ছু বাহিনী:মূলত অল্পবয়সী কিশোর এবং বালকদের নিয়ে গঠিত হতো এই বাহিনী যাদের কাজ ছিলো মুলত গোয়েন্দার। এরা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর গতিবিধি নজর রাখতো এবং ক্যাম্প ও বাংকারগুলোর খুটিনাটি তথ্য যোগাড় করতো। ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেয়েদের উইং ছিলো বিচ্ছু বাহিনীর। এদেরই একজন শহিদুল ইসলাম লালু বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বীরপ্রতীক যিনি গ্রেনেড হামলায় দুটো পাকি বাংকার উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সহজ করে দিয়েছিলেন থানা দখল। 
  3. তুফান বাহিনী ছিলো বিশেষ কমান্ডো ট্রেনিং পাওয়া বাহিনী যারা ঝড়ের মতো এসে কাজ সেরে সেভাবেই হাওয়া হয়ে যেতেন। মুক্তিবাহিনীর এই গেরিলাযোদ্ধাদের তৃণমূল পর্যায়ের সার্বিক সহযোগিতা দিতো সংগ্রাম পরিষদ। প্রতিটি থানা ও মহকুমা পর্যায়ে একাত্তরের শুরুতেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিলো এই সংগ্রাম পরিষদ যারা মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া আশ্রয় এবং নিরাপত্তার দিকটা দেখতো।
ভারতীয় বাহিনীর অস্ত্র সহায়তা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই দেশের ভেতর সাফল্যের সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধ চালিয়েছে কিছু সাহসী তরুণ-যুবা যাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে মাগুরার আকবর বাহিনী (প্রায় দেড় হাজার গেরিলা),যশোর ও খুলনা অঞ্চলে হেমায়েত বাহিনী (৫০০ গেরিলা) খিজির ও রিয়াসাত বাহিনী (১০০ যোদ্ধা),ক্যাপ্টেন জিয়ার বাহিনী (২৫০ জন), শাহজাহান বাহিনী (২৫০ যোদ্ধা),আরেফিন বাহিনী (যোদ্ধা সংখ্যা জানা যায়নি), মেহেদি বাহিনী (৭৫জন গেরিলা); ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে নুরুল আফসার বাহিনী (৪০০ জন), হারুন (১০০ জন);ময়মনসিংহ অঞ্চলে কাদেরিয়া বাহিনী (প্রায় ১৭ হাজার), আবদুল মান্নান (৮৫ জন), আনোয়ারউদ্দিন (১০০ জন)। এদের বেশীরভাগই পরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর আনুগত্য মেনে নেয়।
চীনপন্থী যেসব বাম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বরিশালের পেয়ারাবাগান অঞ্চলে সিরাজ শিকদারের বাহিনী,পাবনায় টিপু বিশ্বাসের বাহিনী,মতিন-আলাউদ্দিন বাহিনী, আবদুর হকের বাহিনী, নোয়াখালি অঞ্চলের কমরেড তোয়াহার লালবাহিনী এবং ফকিরহাট-মিরেরসরাই সীতাকুন্ড অঞ্চলের কাশেম বাহিনী। পাকিস্তানের প্রতি চীনের প্রকাশ্য পক্ষপাতে এরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধকে এরা সোভিয়েত সম্প্রসারনবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের মেলবন্ধন অভিধা দিয়ে কেউ যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় (মতিন- আলাউদ্দিন), কেউ বা পাকিস্তানের পক্ষ নেয় (আবদুল হক), কেউ পাকিস্তানি ও মুক্তিবাহিনী দুইপক্ষের সঙ্গেই যুদ্ধ করে (সিরাজ শিকদার, তোয়াহা, কাশেম)। এর বিপরীতে কমরেড ওহিদুল তার দেড়হাজার যোদ্ধা নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বীকার করে নেন। একইভাবে অগ্নিপ্রভা মিথি তার মিথি বাহিনী নিয়ে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেন। এর বাইরে আরো দুটো চীনপন্থী গ্রুপের কথা না বললেই নয়। কাজী জাফর ও মেনন গ্রুপ মুক্তিবাহিনীর পক্ষ নিলেও মশিউর রহমান-নুরুল কাদির-হুদা গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলে এতে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে।
এছাড়া মুজিব বাহিনীর কথা না বললেই নয় ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়।মুক্তাঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আধিপত্য নিশ্চিত করতে তৈরি হয়েছিলো এই এলিট বাহিনী যাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে তৈরি করা হচ্ছিলো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য। এদের বেশিরভাগ যুদ্ধ করতে পারেননি, বরং স্বাধীনতার পর তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ কাজে লাগান জাসদ ও গণবাহিনী গঠন করে। মুজিববাহিনী গঠনের পর মস্কোপন্থী বামেরা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে ২০ হাজার সদস্যের একটি পৃথক দল গঠন করে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। ঘোড়াশাল, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, নরসিংদি, কুমিল্লা ও ঢাকা অঞ্চলেই মূলত যুদ্ধ করে তারা। এছাড়া ঢাকা তোলপাড় করা ক্র্যাকপ্লাটুনের বেশীরভাগ সদস্যই ছিলো মস্কোপন্থী বাম বা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য।
এবার আসা যাক নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গড়া স্বাধীন বাংলা রেজিমেন্টের বিষয়ে। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ১, ৩ ও ৮ নং ব্যাটেলিয়নকে মেঘালয়ের তুরায় পাঠানো হয়।সেখানে তাদের পুনর্বিন্যস্ত করা হয়।একইভাবে ত্রিপুরায় অবস্থিত ২ ও ৪ নং ব্যাটেলিয়নকে বিন্যস্ত করা হয়। সেপ্টেম্বরে আরও তিনটি নতুন ব্যাটেলিয়ন গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রশিক্ষিত গেরিলা, জুনিয়র ক্যাডেট অফিসার এবং বাকি পাচ ব্যাটেলিয়ন থেকে বাছাই করে নভেম্বরের শেষ নাগাদ গঠিত হয় আটটি পদাতিক বাহিনী যারা ছিলো যুদ্ধউপযোগী এবং সমরাস্ত্রে সজ্জিত। যদিও নতুন তিন ব্যাটেলিয়ান যুদ্ধের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রস্ততির মতো প্রশিক্ষণ পায়নি।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা গোলন্দাজ বাহিনীর ৮০ জন বাঙালী সদস্যকে নিয়ে ত্রিপুরায় গঠিত হয় মুজিব ব্যাটারি নামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ফিল্ড ব্যাটারি। তাদের দেওয়া হয় চারটি ৩.৭ ইঞ্চি হাওইটজার গান। অক্টোবরে শিলচরে দ্বিতীয় ফিল্ড ব্যাটারিটি সংগঠিত হয় ছয়টি ১০৫ এমএম ইটালিয়ান গান সহকারে।পরে এই অস্ত্রসম্ভার দুভাগ করে আরেকটি ফিল্ড ব্যাটারি গঠন করা হয়। নভেম্বরের শেষ নাগাদ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আটটি ব্যাটেলিয়ান তিনটি ব্রিগেড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অধিনায়কদের নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে তাদের নাম হয় যথাক্রমে জেড ফোর্স (জিয়াউর রহমান), এস ফোর্স (সফিউল্লাহ)এবং কে ফোর্স (খালেদ মোশাররফ)। জিয়ার জেড ফোর্সে ছিলো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১,৩ ও ৮ নং ব্যাটেলিয়ন এবং ২ ফিল্ড ব্যাটারি। ১০ ও ১১ নং ব্যাটেলিয়ান এবং তিনটি ইটালিয়ান ১০৫এমএম গান নিয়ে গঠিত তিন ফিল্ড ব্যাটারির কমান্ড পান খালেদ মোশাররফ। সফিউল্লাহর এস ফোর্সে ছিলো ২,৩,৯ নং ব্যাটেলিয়ান এবং ১ নং ফিল্ড ব্যাটারি। পাশাপাশি ৫৫০ জন নৌকমান্ডোকে নিয়ে এবং পাকিস্তান নৌ বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা কিছু নৌঅফিসার ও সেনাকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী। অক্টোবর নাগাদ দুটো হেলিকপ্টার এবং একটি করে ওটার ও ডাকোটা বিমান নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। দুটো বিমানেই রকেট এবং মেশিনগান সংযুক্ত এবং তা থেকে বোমা নিক্ষেপ করা যেতো। ইপিআর পুলিশ আনসারের মতো আধাসামরিক বাহিনীর ৯ হাজার ৬৬০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত মুক্তিফৌজকে ৪৫টি কোম্পানিতে ভাগ করে বিভিন্ন সেক্টরে বিন্যস্ত করে দেওয়া হয় নিয়মিত বাহিনী এবং গেরিলাদের সঙ্গে।
২০ নভেম্বর রোজার ঈদের পর থেকেই ঘুরে যায় যুদ্ধের মোড়। ভারতীয় সেনাবাহিনী অনেকটা প্রকাশ্যেই আর্টিলারি সাপোর্ট দিতে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের।সেই সুবিধা নিয়ে দেশের বিস্তির্ণ অঞ্চলে পাকিস্তানীদের বিচ্ছিন্ন এবং কোনঠাসা করে ফেলে মুক্তিবাহিনী। জাতিসংঘ ও পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানকে বাচানোর শেষ প্রয়াস হিসেবেই ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করে পাকিস্তান। লড়াই শুরু হয়ে যায় দুই ফ্রন্টে। পুর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ ভারত মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে শুরু হয় কনভেনশনাল ওয়ার। ইতিমধ্যে আকাশ এবং নৌপথ জেতা হয়ে গেছে তাদের।স্থলপথের পুরোটাই সহজ এবং নিরাপদ করে রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নিলো আরাধ্য বাংলাদেশ, যার জন্য এত সংগ্রাম, এত রক্ত, এত ত্যাগ।
মাত্র সাড়ে চারহাজার পাকিস্তানী মারা নিয়ে হতাশ হবেন না প্লিজ। মনে রাখবেন নিয়মিত বাহিনীর প্রশিক্ষিত সেনা অফিসাররা এই অসীম সাহসী আবেগীদের একটু গুলি ছুড়তে শিখিয়ে মরতে পাঠিয়ে দিয়েছে প্রাথমিক ঝামেলা সেরে যুদ্ধটা তাদের জন্য একটু নিরাপদ করতে। আসল কাজটা এরাই সেরেছে। এদের জন্যই মনোবলের তলানীতে পৌছানো পাকিস্তানীরা সুযোগ পাওয়া মাত্র সাদা পতাকা উড়িয়েছে। মনে পড়ছে ২০০৮ সালের ৩০ মার্চ জেনারেল জ্যাকবের নেওয়া সাক্ষাতকারের শেষ কথাগুলো:

Last of all, I want to tell you something. The freedom fighters and the East Bengal Regiment, who with their limited resources fought a mighty regular army, earned the liberation of Bangladesh and it was their love for the country that made them victorious. We helped them, we were brothers in arms. But it was their fight, they fought it. They fought with passion and they achieved what they fought for. I give my heartiest blessings and share the pride for them. They are the gems your country should be proud of.

হেল আম প্রাউড অব দেম ম্যান। আই চেরিশ দেয়ার প্রাইড…