Thursday, November 6, 2014

এরিক প্রিবক বনাম গোলাম আযম



এরিক প্রিবকের জন্ম ১৯১৩, মৃত্যু ২০১৩। বেঁচে ছিল পুরা একশ বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাটা ছিল এসএস পুলিশ বাহিনীর কাপ্তান। যুদ্ধের সময় গুনেগুনে ইতালির ৩৩৫ জন সাধারণ নাগরিককে হত্যার মূল কাণ্ডারি ছিলেন তিনি। ২৩শে মার্চ ১৯৪৪ এ ইতালিতে জার্মান বাহিনী স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। খণ্ড যুদ্ধে মারা যায় ৩২ জন জার্মান সেনা । হিটলারের কাছে খবর যাওয়া মাত্রই নির্দেশ আসে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি একটা জার্মান লাশের বিনিময়ে দশটা লাশ নামাতে। প্রিবকের উপর দায়িত্ব পরে ৩২০ জনের তালিকা করার। যুদ্ধ করে ৩২০ জনের লাশ না, জেলে বন্দী ইতালীয় নাগরিকদের দিয়ে তালিকা বানানো হয়। তালিকা করতে করতে আরও এক জার্মান সেনার মৃত্যু ঘটে। ৩২০ জনের তালিকাও বেড়ে ৩৩০ করতে হয় হিসেব মতো। জেলে বন্দী লোক দিয়ে তালিকা পূরণ না হওয়াতে বাসায় থাকা সাধারণ নাগরিকদের তালিকাতে ঢুকানো হয়। ৩৩০ জনের তালিকায় স্থানীয় যোদ্ধার সংখ্যা খুবই কম ছিল। বরং বেশিরভাগই বাসা থেকে জেরা করতে অথবা তেমন কোন কারণ ছাড়াই ধরে আনা কিশোর তরুণ বা বৃদ্ধ সাধারণ মানুষ। পরদিন যা হয় তা "Ardeatine caves massacre" নামে কুখ্যাত। বন্দীদের শহরের কাছে এক গুহাতে নিয়ে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। প্রতি ধাপে পাঁচজন করে গুহাতে ঢুকানো হয়, গুলি করা হয়। একের পর এক দলকে ঢুকিয়ে একইভাবে চলতে থাকে। লাশের স্তূপ জমতে থাকে। হিসেবের কিছু গরমিল হয়ে দেখা যায় ৩৩০ জনের বদলে ৩৩৫ জনকে নিয়ে আসা হয়েছে। যাহা ৫২ তাহা তিপ্পান্ন বলে ওই ৩৩৫ জনকেই হত্যার নির্দেশ দেয় প্রিবকে। নিজ হাতে মারেন দুই জনকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রিবকে পালিয়ে চলে যান আর্জেন্টিনা। পাপ ঢাকতে ধর্মের গোসলের চেয়ে বড় গোসল আর নেই। প্রিবকে আবার নতুন করে ব্যাপ্টিজমে দীক্ষা নেয়। চার্চের এক বিশপের সাহায্যে পালায় আর্জেন্টিনাতে। সেখানে মুক্ত মানব হয়ে ঘুরে এক দুই বছর না, টানা পঞ্চাশ বছর! সব কিছু ভালোই চলছিল, লোকে তাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। প্রিবকে বিপদে পড়লো ১৯৯৪ সালে এবিসি চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে। সাক্ষাৎকারে খোলাখুলি কথা বলে সে, কিভাবে সব হল, কিভাবে নির্দেশ আসলো আর সে হত্যা করলো ৩৩৫ জন মানুষকে। তার কথায় কোন অনুতাপ নেই, কৃতকর্মের জন্য কোন অনুশোচনা নেই, কোন আবেগ নেই। তার এই নিরাবেগ সাক্ষাৎকার দেখে অনেক মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়লো। শুরু হল তাকে ইতালিতে ফিরিয়ে এনে বিচার করার জন্য আন্দোলন। প্রিবকের পক্ষের উকিল আর বন্ধুরা শুরু করলো নানা টালবাহানা। তারা একবার অজুহাত দেখায় যেহেতু এতদিন তার বিচার হয়নি তাই তার সব অপরাধ তামাদি হয়ে গেছে। আবার অজুহাত দেখায় সমস্ত কাগজপত্র আগে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে দিতে হবে তারপর তাকে ইতালিতে ফিরিয়ে আনার আলাপ হবে। সতের মাস নানা টালবাহানা সামলানোর পর অবশেষে আর্জেন্টিনা সরকার প্রাইবকেকে ফেরত পাঠায় ইতালিতে। শুরু হয় বিচার।

তারপর এক বিরাট ইতিহাস। সেই একই রকম ইতিহাস। বিচার হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি ইত্যাদি তামাশা। প্রথম ধাপে প্রিবকে বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। কারণ দেখানো হয় সে হিটলারের আদেশ পালন করছিল মাত্র। কোর্ট হাউজের সামনে শুরু হয় বিক্ষুব্ধ জনতার আন্দোলন। প্রসিকিউটদের আপিলে আবারও তাকে হাজির করা হয় কোর্টে। নিজ হাতে যেই দুইজনকে মারেন সেই হত্যার জন্য এবার বিচার হয় তার। সেইসাথে হিটলারের নির্দেশ অনুসারে ৩৩০ জনের জায়গায় মারা হয় ৩৩৫জনকে, সেই পাঁচজন হত্যার দায় প্রিবকের উপর বর্তায়। দুই বছরের বিচারকার্য শেষে প্রাইবকেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। বয়সের অজুহাত দেখিয়ে সেই পনের বছরকে দশ বছর করা হয়। আবারও শুরু হয় জনরোষ। আপিলের পর এবার ১০ বছরের জায়গায় তাকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়, তবে কারাদণ্ড নয় আরামদণ্ড! বয়সের অজুহাত দেখিয়ে তাকে জেলে না রেখে গৃহবন্দী করার আদেশ হয়।

ক্ষুব্ধ জনগণের আন্দোলন আর প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায় প্রিবকের জীবন। ২০০৭ সালে কোর্ট প্রিবকে কে কাজ করার জন্য বাড়ি থেকে বের হবার অনুমতি দেয়! জনগণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে কোর্ট আদেশ বদল করে আবার তাকে গৃহবন্দী করে। এরই মাঝে একদিন প্রিবকে একদিন সেঞ্চুরি পূরণ করে ফেলে। একশতম জন্মদিনে তার নাতি তাকে শ্যাম্পেন উপহার দিতে গিয়ে আবার পাবলিকের রোষের মুখে পড়ে। লোকজন আস্তে আস্তে অনেকে প্রিবকে কে ভুলে যায়। অনেকে ভুলতে পারেনা। অক্টোবর ২০১৩ তে প্রিবকের মৃত্যু হয়। সহজ সাধারণ বয়স জনিত মৃত্যু। তার শেষ ইচ্ছা ছিল তাকে যেন তার আর্জেন্টিনাতে তার স্ত্রীর পাশে সমাহিত করা হয়। আর্জেন্টিনা সরকার তার লাশ ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করে। তার জন্ম যেই দেশে সে জার্মানিও তার লাশ নিতে রাজী হয়না। ভ্যাটিকান নিষেধাজ্ঞা জারি করে কোন ক্যাথোলিক চার্চে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করার প্রতি। বিচ্ছিন্ন এক ছোট ক্যাথোলিক গ্রুপ তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে রাজী হয়।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় আবার শুরু হয় প্রতিবাদ। প্রিবকের প্রতি সহানুভূতিশীল গ্রুপের সাথে এতদিন ধরে প্রাইবেকের বিচার চেয়ে আসা গ্রুপের গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। গণ্ডগোলের মুখে শেষ পর্যন্ত প্রিবকের পরিবারের কেউ তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যোগ দেয়ার সুযোগ পায়না। প্রতিবাদকারীদের একটাই দাবী, প্রিবকের লাশ ইতালির বুকে রাখা যাবে না। প্রচণ্ড রায়ট শুরু হয়ে যাওয়াতে ইতালি সরকার প্রিবকের লাশ সরিয়ে নিয়ে যায় মিলিটারি বেইজের ভেতর। শেষপর্যন্ত প্রিবকের লাশ কি সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয় না পুড়িয়ে দেয়া হয় না অন্য কিছু তা জানার উপায় নেই। সরকার জানিয়ে দেয় প্রিবকে কে এক অজানা স্থানে কবর দেয়া হয়েছে। সেই অজানা স্থান কোথায় সেটা তার পরিবারের কাউকেও জানানো হয়নি।

আমি উইকিপিডিয়াতে প্রিবকের এই কাহিনী বসে বসে পড়ি আর হাসি। প্রিবকের ট্রায়াল নিয়ে অনেক ইতালিয় নাগরিক এখনও ক্ষুব্ধ, ন্যায় বিচার পাওয়া যায়নি বলে। মন চায় ইতালিয়দের গিয়ে ওই জোকটা বলে সান্ত্বনা দেই, জঙ্গলে গিয়ে বানর দলের হাতে আটকা পড়ছে তিন লোক। তিনজনকে আদেশ করা হল জঙ্গলে গিয়ে কোন একটা ফল নিয়ে আসতে। প্রথমজন লিচু নিয়ে আসলো, বানর রাজ সেই লিচু ভরলো ওই লোকের ইয়েতে, দ্বিতীয়জন আম নিয়ে আসলো তার একই পরিণতি হল। কিন্তু দুইজনেই দাঁত কেলিয়ে খুশিতে হাসতে লাগলো। বানর রাজ ঝাড়ি দিয়ে বলল ব্যাটারা হাসস কেন। বলে আমরা আসার সময় দেখলাম তৃতীয়জন হেলতে দুলতে কাঁঠাল নিয়ে আসতেছে, এই দেখে হাসি।

এরিক প্রিবকে যদি লিচু হয় তবে গোলাম আযম কাঁঠাল। নাহ শুধু কাঁঠাল না, রীতিমতো কাঁঠাল গাছের বাগান। এরিক প্রিবকের বাপ এসে আমাদের আস্ত কাঁঠাল বাগান পুরে দিয়ে গেল। কত কত ৩৩০ এর তালিকা করে গেল, প্ল্যান করে গেল, মেরে গেল। তারপর প্রায় সেঞ্চুরি পূরণ করে বিছানায় বসে স্যুপ খেতে খেতে মরে গেল। এখন হয়তো অতীতের কথা ভুলে সামনে এগিয়ে যাবার আহ্বান আসবে। বিভক্তি ভুলে দেশের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার উপদেশ আসবে। গুরুজনকে সম্মান করার কথা আসবে। গালিগালাজ না করে যুক্তি দিয়ে মিষ্টি করে কথা বলার আহ্বান আসবে। ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা আসবে। সবাই বছর খানেকের মধ্যে গোলাম আযমের কথা ভুলে যাবে। কিন্তু গুটি কয়েক মানুষ হয়তো কখনোই ভুলতে পারবে না।

তিনশ কে দশ দিয়ে গুন করলে হয় তিন হাজার, একশ দিয়ে গুণ করলে তিরিশ হাজার, এক হাজার দিয়ে গুণ করলে তিন লাখ, দশ হাজার দিয়ে গুণ করলে তিরিশ লাখ।

গোলাম আযম কোন এরিক প্রিবকে ছিল না। গোলাম আযম হিটলার ছিল। গোলাম আযম কারো নির্দেশে হত্যা করেনি। তার নির্দেশে হত্যা হয়েছে। একশ দুইশ তিনশো হত্যা না, লাখের পর লাখ। চারিদিকের সুশীলেরা রক্ত পরিষ্কারের জন্য, ময়লা পরিষ্কারের জন্য এখন বিবৃতি দিয়েই যাবে দিয়েই যাবে। বলবে, মৃত্যু সবকিছুর ঊর্ধ্বে। মৃত মানুষের কোন পাপ থাকে না। কেউ বলবে, ঘৃণার চাষ করে কোন লাভ হয়না। ঘৃণা ফেলে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

শুধু অল্প কিছু মানুষ সেই ঘৃণা নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকবে। অল্প কিছু মানুষ জানবে মৃত্যুতে কোন বদল হয়না। শুয়োর মরলে মানুষ হয়ে যায়না, শুয়োরই থাকে।

রোগের নাম ‘নার্সিসিজম’ – আক্রান্ত অনেকেই

'নার্সিসিজম’ সম্পর্কে এখন অনেকেই বেশ অবগত। অন্তর্জালে এ বিষয়ক তত্ত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্য আপনার আগ্রহকে উষ্কে দেবার জন্য যথেষ্ঠ। মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী এটি এক ধরনের অসুস্থ্যতা, যার কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণ ব্যক্তির আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে আচরণগত এসব বৈশিষ্ট্যের বেশ কয়েকটি আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই আছে। কিন্তু সেটা রোগলক্ষণ কিনা তা নির্ভর করে এসবের মাত্রার উপর। তার আগে নার্সিসিজম আসলে কী তা জানা জরুরী। তবে সবার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক গ্রিক পুরাণের দেব-দেবীর কাহিনীর সাথে ‘নার্সিসিজ্‌ম’ শব্দের সম্পর্কটি জেনে নেয়া যাক।
স্বর্গরাণী হেরাকে কথায়-গল্পে মাতিয়ে রাখতো তাঁর আজ্ঞাবহ প্রকৃতি দেবী একো। দারুন মজার এসব দীর্ঘ গল্প শুনে হেরা ভীষণ মুগ্ধ হতেন। আর এভাবেই কেটে যেতো অনেক সময়। এই ফাঁকে তার ভাই ও স্বামী দেবরাজ জিউস প্রমোদে মত্ত হতেন পাহাড়ে, জঙ্গলে থাকা অন্য দেবীদের সাথে। এক সময় স্বামীর এসব কীর্তি সম্পর্কে হেরা আঁচ করতে পারলেন এবং ক্ষুব্ধ হলেন একোর উপর। কারণ কৌশলী একোই তাকে গল্প শোনায় ব্যস্ত রেখে জিউসের এইসব রতিলীলার সুযোগ করে দিয়েছে। তাই শাস্তিস্বরূপ হেরা একো’র কথা বলার শক্তি কেড়ে নিলেন। এখন শুধু অন্যের কথার শেষটুকু প্রতিধ্বনি করতে পারে সে। এদিকে ঘটলো আরেক কাহিনী। নদী-দেবতা কিফিসস-এর ছেলে নার্সিসাস হরিণ শিকারে বেরিয়েছেন। দুপুর রোদে দুরন্ত এক হরিণকে ধাওয়া করার এক পর্যায়ে একো’র নজরে পড়েন তিনি। নার্সিসাসের প্রেমে উতলা হয়ে একো নিজেকে নিবেদন করে তার কাছে। আত্ন-অহংকারী নার্সিসাস প্রত্যাখান করেন একোকে। আর এতে প্রতিশোধের দেবতা নেমেসিস রেগে গেলেন। আর শাস্তি দিলেন এই অহংকারীকে। কী সেই শাস্তি? শিকারের পেছনে ছুটে ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত নার্সিসাস এক ঝর্ণার কাছে এলেন। ঝর্ণার পানিতে নিজের প্রতিকৃতি দেখে এমনই সম্মোহিত হলেন যে, ওখানেই পড়ে রইলেন। তিনি বুঝতেই পারলেননা যে এটা তার নিজেরই চেহারা। একসময় ওখানেই ডুবে মরলেন। আর ওই জলের ধারে জন্ম নিলো ফুলের এক গাছ। ফুলের নাম নার্সিসাস। পুরানের এই ঘটনা থেকেই ইংরেজি নার্সিসিজম শব্দের জন্ম। এর মানে নিজের মধ্যে একান্ত অভিনিবিষ্টতা, নিজের সৌন্দর্য আর সক্ষমতার অতিশায়িত অনুভূতি যা নিজের প্রতি নিমগ্নতা তৈরি করে। এক কথায় একে অতিশয় আত্নপ্রেম বলা যেতে পারে।  বিজ্ঞানীরা আরেক নতুন কথা শুনাচ্ছেন এখন। সেটি হলো, ঘণ্টায় ঘণ্টায় যারা ফেইসবুকে সেলফি আপলোড করেন তারাও নাকি এক ধরণের নার্সিসিস্ট!

নার্সিসিজম রোগের কেতাবি ‘নাম নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজওর্ডার’ বা ‘এনপিডি’।বাংলায় বলা যেতে পারে ‘অতি আত্ম-প্রেম জনিত ব্যক্তিক আচরণ বিচ্যুতি’। এটিকে শুধু রোগ নয়, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সমস্যা হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।মানুষের প্রধান তিন ধরণের নেতিবাচক ব্যক্তিত্বের (dark triad) অন্যতম হলো এই নার্সিসিজম। অন্য দুটি ধরণ হলো ম্যাকিয়াভিলিয়ানিজ্‌ম এবং সাইকোপ্যাথি।  তবে নিজের প্রতি সম্মানবোধ বা নিজের পারদর্শীতার উপর আস্থা কিংবা নিজের অর্জনের প্রতি ভালোবাসাজনিত সাধারণ যে অহম, যা প্রত্যেকেরই থাকে এবং থাকা উচিৎ, তা কিন্তু নার্সিসিজম তথা এনপিডি নয়। এই অক্ষতিকর ব্যক্তিত্ববোধকে ফ্রয়েড নাম দিয়েছেন প্রাইমারি নার্সিসিজম। অবশ্য বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এটি ‘হ্যাল্‌দি নার্সিসিজম’ অর্থাৎ ‘স্বাস্থ্যকর আত্ন-প্রেম’ নামে পরিচিত হতে শুরু করে।
নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজওর্ডার (এনপিডি)-এ আক্রান্তদের মধ্যে নিচের সবগুলো বা বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়ঃ
  • আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ/সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আত্মকেন্দ্রিকতা
  • টেকসই সাবলীল সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা
  • মনস্তাত্বিক সচেতনতার অভাব 
  • অন্যের অনুভূতির বিষয়ে যৌক্তিক ধারণার অভাব
  • নিজেকে অন্যের তুলনায় সর্বদা উচ্চতর অবস্থানে দেখা
  • যেকোন অবমাননা বা কল্পিত অবমাননার প্রতি অতি সংবেদনশীলতা
  • অপরাধবোধে নয়, বরং লজ্জায় বেশি কাতরতা
  • অসৌজন্যমূলক এবং অবন্ধুসুলভ দেহভঙ্গি
  • নিজের প্রশংসাকারীদেরকে তোষামোদ করা
  • নিজের সমালোচকদেরকে ঘৃণা করা
  • পূর্বাপর না ভেবে অন্যদেরকে দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নেয়া
  • আসলে যতোটা না, তার চেয়ে নিজেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবা
  • আত্মম্ভরিতা করা (সুক্ষ্ণভাবে কিন্তু প্রতিনিয়ত) এবং নিজের অর্জনকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে উপস্থাপন করা
  • নিজেকে বহু বিষয়ের পণ্ডিত মনে করা
  • অন্যের দৃষ্টিকোণে বাস্তব পৃথিবী কেমন তা অনুধাবণে অসামর্থ্য
  • অনুতাপ এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশে অস্বীকৃতি/অনীহা

এদিকে স্বনামধন্য মার্কিন মনোচিকিৎসক এবং মনোবিশ্লেষক ডক্টর স্যান্ডি হচ্‌কিস-এর মতে একজন নার্সিসিস্ট-এর সাত ধরণের আচরণগত বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, যেগুলোকে তিনি ‘ডেড্‌লি সিন্‌স’ বা ভয়াবহ পাপ নামে অভিহিত করেছেন। এগুলো হলোঃ
  • লজ্জাশূণ্যতা
  • অধিভৌতিক ভাবনা
  • ঔদ্ধত্য
  • হিংসা
  • বশ্যতা প্রাপ্তির উচ্চাভিলাস
  • ঠকবাজি
  • সীমাহীন অধিকারবোধ
এবার আসা যাক ‘হেল্‌দি নার্সিসিজম’ প্রসঙ্গে। হেল্‌দি নার্সিসিজম হলো নিজের সত্তার এক সুস্থিত সত্য বা সত্যোপলব্ধি, নিজের প্রতি নিজের এবং অন্য বস্তুর আনুগত্য অর্জন, সত্তার স্বাভাবিকতা এবং পরম অহংবোধের সুসংহত অবস্থা, এবং প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ও উম্মত্ততার মধ্যে বিরাজমান ভারসাম্য। এটি ব্যক্তির মাঝে এক ধরণের অপরিবর্তনীয়, বাস্তবধর্মী স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা এবং পরিণত লক্ষ্য ও বিশ্বাস আর সেই সাথে বস্তু-কেন্দ্রিক সম্পর্ক গঠনের সক্ষমতা তৈরি করে। এটা অনেকটা অনিরাপত্তা ও অপর্যাপ্ততা প্রতিরোধী একধরণের আত্মবিশ্বাস। মানুষের স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের বিকাশে হেল্‌দি নার্সিসিজম অত্যাবশ্যকীয়। এতে আত্মপ্রেম অবশ্যই আছে তবে তা চারপাশের বাস্তবতাকে লীন করে এককেন্দ্রিকতা দেয়না। তাই এটি রোগের কোনো লক্ষণ নয়। এটি মানসিক সুস্বাস্থের সহায়ক।

এটা ঠিক যে, এই এনপিডি নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন এবং মতামত দিয়েছেন। আর এভাবেই এর প্রকরণে যোগ হয়েছে নিত্য নতুন মাত্রা। যেমন এই শতাব্দীর একজন খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী সুইজারল্যান্ডের এ্যলিস মিলার, ২০১০-এর এপ্রিলে যার জীবনাবসান হয়েছে, নতুন এক অভিধা যুক্ত করেছেন যার নাম ‘নার্কাস্টিক এ্যবিউজ’ যা দ্বারা শিশুদের উপর বাবা-মা কর্তৃক একধরণের মানসিক নির্যাতনকে বুঝায়। এ্যলিসের ভাষায় এ ধরণের বাবা-মা হলেন ‘নার্সিসিস্টিক প্যারেন্ট্‌স, যারা অল্প বয়ষ্ক সন্তানের স্বতসস্ফূর্ত ইচ্ছের বিকাশকে রুদ্ধ করে নিজেদের সম্মান বৃদ্ধির প্রয়োজনে, কিংবা নিজেদের অপূর্ণ ইচ্ছেকে সন্তানের ভেতর বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যেকোন চেষ্টায় পিছপা হননা। মূলত, বাবা-মা নিজেদের স্বপ্নের স্বাদ ঘোলে মেটানোর আশায় তারা সন্তানের উপর চাপিয়ে দেন তাদের রচিত স্বপ্ন নামক নিষ্ঠুরতা। এর ফলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরণের বাবা-মার সাথে শীঘ্রই সন্তানের দূরত্ব তৈরি হয়, আর তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো সন্তানের ভেতর আত্ন-হনের প্রবণতা তৈরির সম্ভাবনাও কম নয়।

কর্মক্ষেত্রেও নার্সিসিজমের উপস্থিতি লক্ষনীয়, যা কর্মচারী এবং মালিক উভয়ের মাঝেই থাকতে পারে। একে বলা হয় কর্পোরেট নার্সিসিজম। যে মালিকের কাছে প্রফিট-ই একমাত্র লক্ষ্য, কিন্তু কর্মচারীর সুবিধা-অসুবিধা, স্বাস্থ্য এবং ঝুঁকির বিষয়টি কখনোই তার মাথায় আসেনা—তিনি আসলে নার্সিসিজমের শিকার। মালিক রোগীর এধরণের সংকীর্ণ মানসিকতা স্বল্পমেয়াদে বেশ সুবিধা বয়ে আনলেও আখেরে প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে একজন নার্সিসিস্ট কর্মচারী কর্মক্ষেত্রে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগে অদক্ষ হয়ে থাকেন। আর তার অতি সংবেদনশীলতা তাকে একসময় সন্ত্রস্ত করে তোলে। প্রায়শঃ তিনি সহকর্মীদের স্বাভাবিক ব্যবহার/আচরণকেও ভুল বুঝে কষ্ট পান এবং খুব সজেই অনেক বেশি আক্রান্ত বোধ করেন। ফলে কর্মক্ষেত্রে তার নিজের উৎপাদনশীলতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়, যা তার অবস্থান এবং আত্মসম্মানবোধকে আরও বেশি আহত করে।

‘কনভার্সেশনাল নার্সিসিজ্‌ম’ বলতে কথোপকথনের সময় আত্মমগ্নতার এক বিশেষ প্রকাশকে বুঝায়। এটা সাধারণত বন্ধু-বান্ধব, নিকট আত্নীয়-স্বজনদের মাঝে কথা বলার সময় এই আচরণ খুব সহজে পড়ে। একজন নার্সিসিস সাধারণত কারও সাফল্য কিংবা আনন্দের গল্প শুনতে আগ্রহী নন, বরং অন্যের কথা বলার সময় নিজেরটা চাপিয়ে দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন। অন্যের কাছ থেকে নিজের প্রশংসা শোনার জন্য ভীষণ ব্যাকুলতা থাকেন তিনি, এবং প্রশংসাকারী ব্যাতীত অন্য কারো গুণের কথা সাধারণত তিনি স্বীকার করেননা এবং তাদের সাথে তার সখ্যও হয়না। নিজের প্রাপ্তি আর সম্ভাবনার কথা প্রচার করতে এ ধরণের রোগী এতো মরিয়া হয়ে উঠেন আর বিষয় বর্ণনায় এতো অতিরঞ্জন করে থাকেন যে অন্যেরা বিরক্ত হতে বাধ্য হন। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, মোল্লা, আইনজীবিদের অনেকের মাঝে এই ধরণের প্রবণতা সহজেই চোখে পড়ে। সমালোচনাকারী আর শত্রু এদের কাছে সমার্থক। এরা সাধারণত আত্মসমালোচনা করতে অপারগ। আত্নম্ভরিতার চর্চায় স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কোনো কিছুকে বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে এরা সবার অলক্ষ্যে অনেকটা প্রতিবন্ধী হয়ে সমাজে বাস করতে থাকেন, বিনা চিকিৎসায়।

‘সেক্সুয়্যাল নার্সিসিজ্‌ম’ বলতে নিজের যৌনতা কিংবা প্রেমিক-সত্তার সক্ষমতাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সব সময় নিজেকে কল্পনা করার প্রবণতাকে বুঝায়। কল্পনার এই নিমগ্নতা খুব দ্রুত দেহ-ভঙ্গি বা অন্যান্য বাহ্যিক আচরণে প্রকাশ পেতে থাকে। ছেলেদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এ ধরণের নার্সিসিস্টরা প্রেমকে যৌনতার প্রাপ্তি দিয়ে বিচার করতে পছন্দ করে। এর ফলে এরা সত্যিকারের আত্মিক সম্পর্কের চর্চার ব্যাপারে উদাসীন থাকে। নানাবিধ যৌন বিকার, নারীর উপর যৌন-নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতনের কারণ হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই সেক্সুয়াল নার্সিসিজ্‌ম দায়ী বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা।

এখন প্রশ্ন হলো এই রোগের কবল থেকে বাঁচার উপায় কী? এ ব্যাপারে প্রথমেই বলতে হয় যে, এটি নিজে নিজে সারানো বেশ মুশকিল। প্রথমত, এটা অনেকগুলো আচরণগত বৈশিষ্ট্যের সমম্বয়ে সৃষ্ট এক ধরণের জটিল সমস্যা, যা হুট করে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে দূর করা সম্ভব নয়, যেখানে ধূমপানের মতো অভ্যাসকে ত্যাগ করাটাই অসম্ভব মনে হয় ধূমপায়ীর কাছে। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ সম্পর্কিত সচেতনতার মানে এই নয় যে তিনি বুঝে গেছেন করণীয় কী, কারণ রোগের ধরণ অনুযায়ী প্রতিকারের উপায় সচেতনতা দিয়ে জানা সম্ভব নয়—এজন্য দরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পেশাদারী অভিজ্ঞতা। সেজন্য  একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট/থেরাপিস্ট-এর বিকল্প খুঁজতে যাওয়া নিতান্তই অনর্থক। তবে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে, দুঃখকে বুঝবার এবং মনোযোগি শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা করা, নিয়মিত আত্ম-সমালোচনা করা, বই পড়া, নতুন বন্ধু তৈরি করা এবং সামাজিক কাজকর্মে খোলা মন দিয়ে অন্যদের সাথে অংশগ্রহণ করা, ইত্যাদি এই রোগের নিরাময়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে। আসুন আমারা নার্সিসিজ্‌ম থেকে নিজেরা দূরে থাকি, অন্যদেরকেও দূরে রাখি।

Wednesday, January 29, 2014

আত্মপলব্ধি অথবা সীমাবদ্ধতা


sometimes why i feel so helpless???
is it just because of my mental stress which i am having all day or my less intelligence or anything else?