Monday, November 10, 2014

বঙ্গবন্ধু: রাজবন্দীর চিঠি… বাজেয়াপ্ত

১৯৫১ সালে কারাগারে রাজবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৫১ সালে কারাগারে রাজবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান
অখন্ড পাকিস্তানের ২৩ বছরের প্রায় অর্ধেকটাই জেলে কেটেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। নির্দিষ্ট করে বললে ১২ বছর, আর দশ বছর কড়া নজরবন্দীতে কাটিয়েছেন এতটাই মাথাব্যথা ছিলেন পাকিস্তান সরকারের, সেটা গণতান্ত্রিক হোক কিংবা সামরিক। এই পোস্টটি তার সেই জেল জীবনের সময়কার কিছু বাছাই চিঠি নিয়ে। রাজবন্দীদের সব চিঠিই সেন্সর হয়। এই সেন্সরশীপের মাত্রা পার হতে না পারলেই সেসব বাজেয়াপ্ত হতো। তারপর জমা পড়তো সরকারী বিশেষ বিভাগের ফাইল ক্যাবিনেটে। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের ফাইলপত্র থেকে উদ্ধার করা এই চিঠিগুলো তুলে দিলাম। এরমধ্যে শুধু একটি চিঠির প্রাপক বঙ্গবন্ধু, যা তার হাতে পৌছেনি, বাকিগুলা তার লেখা যা সরকারী হস্তক্ষেপে প্রাপকের হাতে পৌছেনি।
১১ মার্চ, ১৯৪৮। সচিবালয়ের গেটের সামনে মাটিতে শুয়ে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিব
১১ মার্চ, ১৯৪৮। সচিবালয়ের গেটের সামনে মাটিতে শুয়ে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ মুজিব
প্রতিটা চিঠিই স্বকীয়তায় ভাস্বর। নিতান্ত স্বাভাবিক চিঠিও ঐতিহাসিক গুরুত্বের এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্কের ঘনিষ্টতা ও আস্থার মাত্রা সম্পর্কে ধারণা দেয়। পাশাপাশি শেখ মুজিবের কয়েদাবাসের সময়কার মানসিক অবস্থা তুলে ধরে। বাবাকে লেখা চিঠিতে যেমন রাজনীতির প্রতি হতাশা ও ক্ষোভ জানিয়ে তা ত্যাগ করার কথা ভাবছিলেন।একইসঙ্গে মুজিব পরিবারের আর্থিক দৈন্যতারও ইঙ্গিত মিলেছে সেখানে যা তার রাজনীতিরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। চমকপ্রদভাবে এই দেশের সাধারণ মানুষর রাজনৈতিক বিবেচনাবোধ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মুজিব বিশেষ করে যারা রাজনৈতিক অপপ্রচারকে গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বাস করে অভ্যস্ত। জহুর আহমেদ চৌধুরী, তাজউদ্দিন আহমেদ ও এমএ আজিজের সঙ্গে সম্বোধনের তারতম্যে ফুটে উঠেছে তার সম্পর্কের গভীরতা। খুব কমন এবং ক্যাজুয়াল কথাবার্তা হলেও সহযোদ্ধাদের প্রতি মুজিবের মমতার জায়গাটা লক্ষ্যনীয়। তবে পোস্টের সবচেয়ে চমকপ্রদ উক্তিটা ভাসানীর, যা মুজিবের জেল যাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ২০ বছর পর সত্যিই ফলে গিয়েছিল। ভাসানী লিখেছিলেন: ‘দেশের মুক্তির সঙ্গে তোমার মুক্তি।’ প্রিয় পার্টি সেক্রেটারির প্রতি কি আস্থা রাখতেন ভাসানী তারই প্রমাণ মেলে এই একটা কথাতেই।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে, সবার বাঁয়ে তাজউদ্দিন
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে, সবার বাঁয়ে তাজউদ্দিন
দুটো বাড়তি চিঠি আছে পোস্টের শিরোনামের সঙ্গে সম্পর্কহীন। এর একটি জেল থেকে বেগম মুজিবকে লেখা যা বাজেয়াপ্ত হয়নি, তবে বাবাকে লেখা চিঠিটার সঙ্গে সম্পূরক। আর শেষ চিঠিটি শেখ হাসিনাকে লেখা। গণঅভ্যুথানের পর জেল থেকে বেরিয়ে স্বামীর সঙ্গে প্রবাসী বড়মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন। পাঠকদের সুবিধার জন্য ইমেজ ফাইলের পাশাপাশি চিঠির টেক্সটও তুলে দেওয়া হলো।
বাঁ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু
বাঁ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু
১ম চিঠি: শেখ মুজিবকে মাওলানা ভাসানী, ৩০ এপ্রিল, ১৯৫১
১৮ নং কারকুন বাড়ি লেন
ঢাকা, ৩০-৪-৫১
দোয়াবরেষু,
আমি সর্বদাই গ্রাম অঞ্চলে বাস করি কারণ গ্রামের মরণাপন্ন (চিঠিতে বানান মরণাপন্য) কৃষক-মজুরদের অবস্থা ভাল না হইলে এবং পাকিস্তান শুধু কয়েকজন বড় লোকের নহে। সাড়ে সাতকোটি লোকের পাকিস্তানের উন্নতি স্বজনপ্রীতি, দূর্নীতি,অনাচার, অবিচার দমনের ব্যবস্থা আদর্শ রাষ্ট্রে পরিণত করার দায়িত্ব সকলকেই গ্রহণ করিতে হইবে। প্রাণের চেয়ে প্রিয় জিনিস পাকিস্তানের প্রত্যেক নাগরিককে অনুভব করিতে হইবে। তোমার মুক্তির জন্য সরকারের দৃষ্টি বহুবার আকর্ষণ করিয়াছি কিন্তু ছেলে অন্ধ হইলে নাম পদ্মলোচন রাখলে লাভ কি। ধৈর্য্যধারণ করো আল্লাহ তোমার সঙ্গে আছেন।দেশের মুক্তির সঙ্গে তোমার মুক্তি।সরকার অস্থায়ী প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র স্থায়ী এবং আমাদের।আমার দোয়া জানিও এবং সকল বন্দীদিগকে জানাইও।
আবদুল হামিদ খান ভাসানী
Source: Govt. of East Pakistan, Home poll, F/N, 606-48PF, Part-3

১৯৪৯র এই ছবিতে পিতা শেখ লুতফর রহমানে এবং আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হক, ইয়ার মোহাম্মাদ খান। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হয়েই সোজা কর্মীসভায় যাওয়ার জন্য জিপে চড়ে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু
১৯৪৯র এই ছবিতে পিতা শেখ লুতফর রহমানে এবং আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল হক, ইয়ার মোহাম্মাদ খান। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হয়েই সোজা কর্মীসভায় যাওয়ার জন্য জিপে চড়ে বসেছিলেন বঙ্গবন্ধু
২য় চিঠি: শেখ লুতফর রহমানকে শেখ মুজিব, ১২ নভেম্বর, ১৯৫৮
রাজনৈতিক বন্দী
ঢাকা জেল
১২-১১-৫৮
আব্বা,
আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল, কারণ এবার তার সামনেই আমাকে গ্রেপ্তার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামীও একবার করেছিল। আল্লা আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন বাসায় কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন।বাড়ি যেতে বলে দিতাম।কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে। আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই, এবং রাজনীতি আর করবো না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করবো না। যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোনো কাজই করা উচিত না।এ দেশে ত্যাগ আর সাধনার কোনো দামই নাই। যদি কোনদিন জেল হতে বের হতে পারি তবে কোন কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভাল ভাবে সংসার করবো। নিজেও কষ্ট করেছি, আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন। দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভাল আছি।
আপনার স্নেহের
মুজিব
NB: গোপালগঞ্জের বাসাটা ভাড়া দিয়া দেবেন। বাসার আর দরকার হবে না।
মুজিব
Source: Govt. of East Pakistan, Home poll, F/N, 606-48PF, Part-9
প্রসঙ্গক্রমেই এসে পড়ে বেগম ফজিলাতুন্নেসার কাছে লেখা শেখ মুজিবের একটি চিঠি যা সাক্ষ্য দেয় সংসারে টানাটানির। বাবার কাছে পাঠানো (এবং না পৌছানো) চিঠির মাস কয়েক পর এটি লিখেছিলেন তিনি । এ চিঠির আরেকটি নজরকাড়া বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিটি সন্তানের প্রতি তার পক্ষপাতহীন ভালোবাসা
ঢাকা জেল
১৬-৪-৫৯
রেনু,
আমার ভালোবাসা নিও। ঈদের পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আস নাই। কারণ তুমি ঈদ করো নাই। ছেলেমেয়েরাও করে নাই। খুবই অন্যায় করেছো। ছেলেমেয়েরা ঈদে একটু আনন্দ করতে চায়। কারণ সকলেই করে। তুমি বুঝতে পারো ওরা কতো দুঃখ পেয়েছে। আব্বা ও মা শুনলে খুবই রাগ করবেন। আগামী দেখার সময় ওদের সকলকে নিয়ে আসিও। কেন যে চিন্তা করো বুঝি না। আমার যে কবে মুক্তি হবে তার কোনো ঠিক নাই। তোমার একমাত্র কাজ হবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখানো।টাকার দরকার হলে আব্বাকে লেখিও, কিছু কিছু মাসে মাসে দিতে পারবেন। হাছিনাকে মন দিয়ে পড়তে বলিও। কামালের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল হচ্ছে না। ওকে নিয়ম মতো খেতে বলিও। জামাল যেন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। এবার একটা ছবি একে যেন নিয়ে আসে আমি দেখব। রেহানা খুব দুষ্ট ওকে কিছুদিন পর স্কুলে দিয়ে দিও জামালের সাথে।যদি সময় পাও নিজেও একটু লেখাপড়া করিও। একাকী থাকাতে একটু কষ্ট প্রথম হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে কোন চিন্তা নাই। বসে বসে বই পড়ি। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।
ইতি-
তোমার মুজিব
সূত্র : জাতির জনক প্রকাশনায়-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট, পৃ: ২১০
বাবাকে জেলে দেখেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন মুজিবের চার সন্তান, বা থেকে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ কামাল ও শেখ জামাল
বাবাকে জেলে দেখেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন মুজিবের চার সন্তান, বা থেকে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ কামাল ও শেখ জামাল
৩য় চিঠি: চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী শেখ মুজিব, ৪ আগস্ট, ১৯৬৬
ঢাকা জেল
৪-৮-৬৬
জহুর,
আমার ভালবাসা নিও। কেমন আছ জানি না। তোমার বোধহয় খুব কষ্ট হয়েছে। তোমার বাড়ির খবর কিছু পেয়েছ কিনা জানি না। আমার দিন কোনমতে কেটে যাচ্ছে। আমার জন্য চিন্তা করিও না। আল্লা আমাকে যথেষ্ট সহ্য শক্তি দিয়েছে। তুমি ডিআইবি এসবির কাছে দরখাস্ত করতে পার তোমাকে চট্টগ্রাম পাঠাবার জন্য। কারণ তোমার ছেলেমেয়েদের দেখবার কেহ নাই।চিন্তা করে শরীর খারাপ করিও না। খোদা যাহা করে মানুষের ভালর জন্য করে।
ইতি
তোমার মুজিব
Source: Govt. of East Pakistan, Home poll, F/N, 606-48PF, Part-26

’৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের হওয়ার পর তাজউদ্দিনের সঙ্গে শেখ মুজিব
’৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বের হওয়ার পর তাজউদ্দিনের সঙ্গে শেখ মুজিব
৪র্থ চিঠি: তাজউদ্দিন আহমেদকে শেখ মুজিব, ১৯ আগস্ট, ১৯৬৬
ঢাকা জেল
১৯/৮/৬৬ (সিল)
স্নেহের তাজউদ্দিন
আমার স্নেহ ও ভালবাসা নিও। কেমন আছ? খবর জানি না।আমাকে খবর দিও। চিন্তা করিও না। সকলকে সালাম দিও। শরীরটা বেশী ভাল না তবে কেটে যাচ্ছে। তোমার শরীরের প্রতি যত্ন নিও।
ইতি-
তোমার
মুজিব ভাই
Source: Govt. of East Pakistan, Home poll, F/N, 606-48PF, Part-26
৫ম চিঠি: চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ আজিজকে শেখ মুজিব, ২৩ আগস্ট, ১৯৬৬
ঢাকা জেল
২৩/৮/৬৬
ভাই আজিজ
কেমন আছ? বহুদিন খবরা পাই না তোমাদের। বন্ধুবান্ধবরা কেমন আছে? শরীরের প্রতি যত্ন নিও কারণ তোমার শরীর ভাল না। আমি কোনো মতে আছি। জেল গেটেই আমার বিচার শুরু হয়েছে, দেখা যাক কি হয়। আল্লা আমাকে যথেষ্ট সহ্য শক্তি দিয়েছে।তোমার ছেলেমেয়েরা কেমন আছে? সকলকেই ছালাম ও ভালবাসা দিও।
ইতি
তোমার
মুজিব ভাই
Source: Govt. of East Pakistan, Home poll, F/N, 606-48PF, Part-26
বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে দেওয়া চিঠিটা বাদে উপরের সবগুলো চিঠিই বাজেয়াপ্ত। আর শেখ হাসিনাকে লেখা নিচের চিঠিটি জেল থেকে বের হওয়ার পর। ১৩ জুন ১৯৬৯ সালে লেখা। স্রেফ পাঠকের আগ্রহের কথা ভেবে পোস্টে এটি সংযুক্ত:
ঢাকা
১৩-৬-৬৯
হাচু মনি
আমার স্নেহ ও ভালবাসা নিও।ওয়াজেদের চিঠি পেয়েছিলাম, উত্তরও দিয়েছি বোধ হয় পেয়ে থাকবে।জেল থেকে বের হয়ে তোমাকে ভাল করে দেখতেও পারি নাই। শুধু তোমার শরীরে দিকে চেয়ে তোমাকে যেতে দিয়েছি। শরীরের প্রতি যত্ন নিও। ওয়াজেদের শরীর কেমন? আমরা সকলেই ভাল আছি। চিন্তা করে শরীর নষ্ট করিও না। বোধহয় শুনেছ মানিক ভাই (তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক) পিন্ডিতে হঠাৎ মারা গেছেন।বুঝতেই পার আমার অবস্থা। প্রফেসর হাই সাহেবও মারা গিয়েছেন। বাংলাদেশের দুইজন কৃতি সন্তান আমরা হারালাম। চিন্তা করিও না। সুইডেন খুব সুন্দর দেশ। তোমাদের খুব ভাল লাগবে।চিঠি দিও।ভ
তোমার
আব্বা
সূত্র : জাতির জনক প্রকাশনায়-জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট, পৃ: ২১১
চিঠির হাইলাইট। বাংলাদেশের দুইজন কৃতিসন্তান, পাকিস্তানের নয়।মনে করিয়ে দিই আবার, সালটা ১৯৬৯।

Thursday, November 6, 2014

প্রেমিক হিসাবে বই পড়ুয়া ছেলেরা ভালো!

প্রেমিক হিসাবে বই পড়ুয়া ছেলেরা ভালো!
ভাবছেন এটা আবার কেমন কথা হলো? আসলেই কিন্তু বিষয়টা ভেবে দেখার মত। হ্যাঁ, আজকাল অনেকেই বই পড়েন না ভুলেও। তবে এমন মানুষের সংখ্যা নেহাত কম না, যারা কিনা বইয়ের সাথেই থাকতে ভালোবাসেন। এই বই পড়ুয়া মানুষগুলো কিন্তু বাস্তব জীবনেও অন্যরকম হন। কেমন? এই যেমন বই পড়ুয়া ছেলেরা প্রেমিক হিসাবে চমৎকার হয়ে থাকেন, অন্য যে কোন ছেলের চাইতে ভালো! কিন্তু কেন তাঁরা সেরা? জেনে নিন বই পড়ুয়া প্রেমিকের ১0টি গুণের খবর!
১) তিনি জানেন, তাঁর অভিজ্ঞতা অনেক বেশী
একজন পাঠকের অভিজ্ঞতা অন্য যে কারো চাইতে অনেক বেশী। বইয়ের জগতের মাধ্যমে তিনি রাজপুত্রের জীবন যাপন করেছেন, করেছেন ফকিরের জীবনও যাপন। তিনি জানেন অনেক বেশী, তাঁর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাও বেশী। ফলে তিনি শান্ত ও স্থির। হ্যাঁ, সম্পর্কের ক্ষেত্রেও।
২) মাঝপথে পালিয়ে যাবার প্রবণতা তাঁর নেই
একজন পাঠক কখনো বই শেষ না করে ছাড়েন না। আর সেই অভ্যাসটা দেখা যায় তাঁদের জীবনের ক্ষেত্রেও। কাজ হোক বা সম্পর্ক, কোনটাই তাঁরা মাঝপথে ফেলে রেখে পালিয়ে যান না।
৩) তিনি জানেন সমঝোতা করতে
বইয়ের জগতে বসবাস করতে করতে মানুষের জীবনের নানান পরিস্থিতির সাথে তাঁর পরিচয় হয়। তিনি শিখে ফেলেন জীবনে সমঝোতার গুরুত্ব ও উপায়।
৪) তিনি মেয়েদের সম্পর্কে জানেন ও বোঝেন
পড়ুয়া পুরুষেরা সেই সব ছেলেদের তালিকায় পড়েন না, যারা কিনা শুধু মেয়েদের নিয়ে অলীক কল্পনা করে কাটায়। বরং একজন বই পড়ুয়া পুরুষ মেয়েদেরকে জানেন, বোঝেন, তাঁদের সম্পর্কে ভাবেন এবং তাঁদেরকে দেখেন একদম ভিন্ন চোখে।
৫) তিনি কৌতূহলী
নিঃসন্দেহে পড়ুয়া মানুষেরা কৌতূহলী, আর সে কারণেই তিনি পড়েন। এমন মানুষের সাথে জীবন কখনো একঘেয়ে হয়ে যাবে না, সম্পর্কও না।
৬) প্রথম দর্শনেই তিনি পাগল হন না
একজন ভালো পাঠক জানেন যে প্রথম দর্শনে কোন কিছুকে ভালবাসলে পরে পস্তাতে হয়। জেনে,বুঝে,পড়ে তবেই ভালবাসতে অভ্যস্ত তিনি। আর তাই তিনি যখন আপনাকে ভালবাসবেন, জেনে নেবেন যে কাজটা তিনি জেনে-বুঝেই করছেন।
৭) তাঁর আদর্শ অন্যদের চাইতে উন্নত
একজন বই পড়ুয়া মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের মানুষ তাঁকে অন্যদের চাইতে উন্নত মানুষ হতে সহায়তা করে। স্বভাবতই মানুষ হিসাবে তিনি আদর্শগত দিক থেকে অনেকটাই উন্নত হয়ে ওঠেন। এমন একজন রুচিশীল মানুষের সাথে জীবনটা হয়ে উঠবে সুন্দর।
৮) তিনি চাকচিক্যে ভোলেন না
একজন ভালো পাঠক কেবল বইয়ের মলাট দেখেই ভালোমন্দ বিচার করেন না। আর এই অভ্যাস তাঁর বাস্তব জীবনেও রয়ে যায়। কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে তিনি ভোলেন না, তিনি জানেন সনাতনের গুরুত্ব। সব নতুনই যে ভালো নয়, চকচক করলেই যে সোনা হয় না ইত্যাদি তিনি ভালোই বোঝেন।
৯) তিনি পুরনোকে ভয় পান না, ভালোবাসেন
সম্পর্ক পুরনো হয়ে যাওয়া যে কোন মানুষের বড় ভয়। কিন্তু পড়ুয়া পুরুষদের এটা নেই। পুরনো বইয়ের মতই তাঁরা পুরনো প্রেমিকা ও পুরনো সম্পর্কের কদর করেন।
১০) তিনি জানেন কীভাবে বুঝে নিতে হয়
মনে কথা বুঝতে পারার গুণটি ভালো পাঠক মাত্রই আছে। আর এই গুণ যখন প্রেমিকের মাঝে থাকবে, ভাবুন তো জীবনটা কত সহজ হবে।

একাত্তরের রাজপুত্রেরা

একাত্তরের রাজপুত্রেরা
…আমি ছেলেটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। সদ্য তরুণ। কলেজে পড়ে। হাতের একনলা বন্দুকটির নল মরচেধরা। বুকে আড়াআড়ি বাধা ছেড়া চামড়ার স্ট্রিপ তাতে কিছু আদ্যিকালের কার্টিজ, ফুটবে কিনা সন্দেহ!ছেলেটা যুদ্ধ করতে এসেছে। বললাম, তুমি এই বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করবে! পাকিস্তানীদের মারবে!ছেলেটা আমার চেয়ে অবাক মুখভঙ্গী করে বললো, ক্যানো স্যার, এই বন্দুক দিয়ে আমার দাদা যদি বাঘ শিকার করতে পারেন, আমি মানুষ মারতে পারবো না! (এক মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিকথা)…
ঘটনাটা বললাম সে সময়কার তরুণদের মনোভাবটা বোঝাতে। আজ ফেসবুকে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সৈন্যদের ক্যাজুয়ালটির একটা পরিসংখ্যান তুলে ধরেছিলাম।https://www.facebook.com/notes/mehedi-sultan/979836922042302 আর সেই সংখ্যাটা দেখে অনেকে হয়তো বিস্মিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে এত বিশাল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার হাতে যদি মাত্র হাজার চারেক পাকিস্তানী নিহত হয় তাহলে কি যুদ্ধ করেছেন তারা! এই বিস্ময় আসলে এসেছে কনভেনশনাল বা প্রথাগত যুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে যেখানে শুধু স্থলেই না, আকাশ জল এমনকি অন্তরীক্ষেও (স্যাটেলাইট) লড়াই চলে। একদল প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী যেখানে অবস্থান নেয় সেটার সুরক্ষা তারা নিশ্চিত করে দূর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে। থ্রি নট থ্রি নিয়ে একদল মুক্তিযোদ্ধার কোনো পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করার কল্পনা খুব একটা বাস্তবসম্মত না। যেখানে তাদের কারও ছোড়া প্রথম গুলিটাই প্রতিপক্ষকে অবস্থান জানিয়ে দেবে এবং নিরাপদ বলয়ে বসে তার দিকে ছোড়া হবে অজস্র তপ্তসীসা। এধরণের আক্রমণে এয়ারসাপোর্ট ও আর্টিলারি ব্যাকাপের পাশাপাশি ভারী অস্ত্র থাকা খুব জরুরী। আফসোস বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সেই বিলাসিতার সুযোগ ছিলো না। প্রতিটি গুলি তারা হিসেব করে খরচ করেছেন, করতে বাধ্য হয়েছেন, কারণ সেটা প্রতিপক্ষের মৃত্যুই শুধু নয় তার নিজের জীবনেরও রক্ষাকবচ। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কোনো অবাস্তব মিথ তৈরির অপচেষ্টা না করে বরং জানা যাক তাদের সম্পর্কে জানা অজানা কিছু তথ্য।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানী একবার কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো গণহত্যায় নামা। তারা যদি রাজনৈতিক নেতা বা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেই তাদের অভিযান সীমাবদ্ধ রাখতো তাহলে হয়তো সেনাবাহিনী এবং আধাসামরিক বাহিনীর বাঙালী অফিসার ও সৈন্যরা চুপ থাকতেন। কিন্তু সাধারণ বাঙালীদেরও যখন রেহাই দেওয়া হলো না, শিক্ষক বুদ্ধিজীবিদেরও যখন হত্যা করা হলো, তখন সব শ্রেণীর মানুষই যুদ্ধে নেমে গেলো।’ বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তানীদের পরিকল্পনাই ছিলো তা। নির্মম গনহত্যার মাধ্যমে বাঙালীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ভুলিয়ে দেওয়া। সেই হত্যার প্রতিরোধ,প্রতিশোধই মুক্তিযোদ্ধাদের বুকে আগুন ধরিয়ে তাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে সামিল করেছে। ওসমানীর ভাষায়, ‘পাকিস্তানীরাই প্রতিদিন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করছিলো।’
মুক্তিযুদ্ধের একদম বেসিক ছবিটা তার আগে তুলে ধরা দরকার।মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্বপাকিস্তানের নাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই বাংলাদেশ সরকার ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের মুজিবনগরে আত্মপ্রকাশ করে। এবং সেই সরকার ১০ এপ্রিল প্রকাশিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে জানান দেয় ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন এবং এই সরকার কার্যকর। এই সরকার কোনো সামরিক সরকার নয়, বরং গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার। এই সরকারের নেতৃত্বে এবং তত্বাবধানে ও নির্দেশনাতেই সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, পুলিশ, আনসার এবং গণবাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিত রূপে মুক্তিবাহিনী হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। সারা বিশ্বজুড়ে এই সরকারই স্বীকৃতি পেয়েছে। এবং পাকিস্তানী কারাগার থেকে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু এই সরকারের কাঠামোতেই রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
তবে যতো উদ্দীপনা থাক, দেশপ্রেম থাক এবং প্রতিশোধের আগুন যতোই দাউদাউ জ্বলুক বন্দুক চালাতে না জানলে বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করা যায় না। ঠিক মতো বন্দুক ধরে তাদিয়ে গুলি ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করার মিনিমাম প্রশিক্ষণটা জরুরী। হাজার হাজার যুবক প্রতিদিন সীমান্ত পারি দিয়ে ভারতে যাচ্ছিলো সেই প্রশিক্ষণ নিতেই। আর তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলো ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে বিএসএফই প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য ব্যাপারে সহায়তা দিয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী নয়। মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন ৩০ এপ্রিল ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। অন্যদিকে এক সাক্ষাতকারে লে. জেনারেল বি.এন. সরকার জানিয়েছেন ৯ মে ভারতীয় সেনাপ্রধান তাকে ডেকে বলেন যে ভারত সরকার মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তাদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্রিগেডিয়ার, লে.কর্ণেল এবং মেজর পর্যায়ের কিছু অফিসারকে জরুরী ভিত্তিতে পূর্বফ্রন্টে নিয়ে আসতে হবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড জিওসি-ইন-সির অধীনে আগস্টের শুরুতে মুক্তিবাহিনীর অপারেশনাল ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। তার আগে এই দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল ও. এস কালকাট।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর আমাদের নির্ভরতা ছিলো। কিন্তু তার মানে এই না আমাদের ছেলেরা দলে দলে গিয়ে বলেছে আমাদের বাচাও, পাকিস্তানীরা আমাদের মেরে ফেলছে। বরং তারা গিয়ে বলেছে আমাদের তোমরা অস্ত্র দাও। আমরা আমাদের দেশটাকে পাকিস্তানিদের হাত থেকে মুক্ত করতে চাই। ভারতীয়রা তাদের অস্ত্র দিয়েছে, কিভাবে সেই অস্ত্র চালাতে হয় শিখিয়ে দিয়েছে। আর শিখিয়েছে যুদ্ধের কিছু বেসিক যা না জানলেই নয়। লি এনফিল্ড, মার্ক থ্রি রাইফেল, ব্রিটিশ কারবাইন আর এলএমজি ও কিছু গ্রেনেড নিয়েই দেশ মুক্তিতে নেমে গিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধারা।
তারপরও এই যুদ্ধে তুলনামূলক গুরুত্ব ছিলো নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের। কারণ তারা ছিলেন প্রশিক্ষিত। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকের। এদের মধ্যে সিনিয়র অফিসারদের নিয়ে ৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের একটা রূপরেখা তৈরি করতে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে এক বৈঠক করেন ওসমানী। জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, শফিউল্লাহসহ ছোটবড় ২৭জন অফিসার ছিলেন। সেখানেই কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়, যার মধ্যে প্রধান ছিলো:১. বিশাল একটি গেরিলা যোদ্ধাদল তৈরি করে অন্তর্ঘাত চালাতে হবে যাদের কাজ পাকিস্তানীদের দালালদের হত্যা করা, বিভিন্ন স্থাপনা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করার মাধ্যমে পাকিস্তানীদের চলাফেরায় অচলাবস্থা তৈরি করা। হিট অ্যান্ড রান টেকনিকের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানীদের বিভিন্ন পোস্ট এবং গাড়ি বহরে হামলা চালাবে। এবং এর মাধ্যমে পাকিস্তানীরা সবসময় স্নায়ুচাপে ভুগবে। ২.অস্ত্র চালাতে সক্ষম আধাসামরিক বাহিনী, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন সেক্টরে সেক্টরফোর্স সদস্য হিসেবে সন্নিবেশিত করা হবে এবং তারা এই গেরিলাদের সশস্ত্র সহায়তা দিবে। ৩.নিয়মিত বাহিনী ও গেরিলাদের মধ্য থেকে যোগ্যদের বাছাই করে এবং তাদের প্রশিক্ষন দিয়ে সামরিক বাহিনী গঠন করতে হবে যারা পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র সংঘাতে যাবে।মানে মুখোমুখি লড়াইয়ে নামবে।
১১ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন কমান্ডারদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসে। সেই সম্মেলনে যেসব বিষয় নির্ধারিত হয় তার মধ্যে প্রাসঙ্গিকগুলো ছিলো: ১.বাংলাদেশকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে যুদ্ধ পরিচালিত হবে।২.গেরিলা যুদ্ধকে সমন্বিত করতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়: ক. নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়ে প্রশিক্ষিত গেরিলাদের ৫ কিংবা ১০ জনের দলে ভাগ করে দেশের ভেতরে পাঠানো হবে খ.গেরিলাদের দুই ভাগে ভাগ করা হবে এক. অ্যাকশন গ্রুপ : যারা শত্রুদের উপর আক্রমন করবে এবং তাদের পঞ্চাশ থেকে শতভাগ সশস্ত্র হবে দুই.ইনটেলিজেন্স গ্রুপ : যারা সংঘাত এড়িয়ে শত্রুদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করবে এবং সেসব তথ্য মিত্রদের কাছে সরবরাহ করবে। এদের তিরিশভাগকে সশস্ত্র করা হবে। তিন. গেরিলা বেজ: স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার তত্বাবধানে কয়েকটি সেফ হাউজ চিহ্নিত করে তা গেরিলাদের আবাসন ও আশ্রয়ের জন্য ব্যবহার করা হবে যেখানে মেডিকেল সুবিধা থাকবে। ৩, নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ব্যাটেলিয়ান গড়ে তোলা হবে এবং আধাসামরিক ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গড়া হবে সেক্টর ফোর্স যার অপর নাম স্বাধীন বাংলা রেজিমেন্ট। ৪. সামরিক কর্মকান্ডের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়:ক. গেরিলাদের একটি বিশাল বাহিনীকে দেশের ভেতর পাঠিয়ে শত্রুকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে হবে। তাদের উপর নিয়মিত অ্যামবুশ ও চোরাগুপ্তা হামলা চালাতে হবে। খ. কোনো কলকারখানা চালাতে দেওয়া হবে না। বিদ্যুতের খুটি ও পাওয়ার স্টেশনগুলোতে বোমা হামলা চালিয়ে উৎপাদন ব্যবস্থা বিঘ্নিত করা হবে। গ.প্রতিটি গুদামে হামলা চালিয়ে তা ধ্বংস করে দিতে হবে যাতে পাকিস্তানীরা কোনো পন্য রপ্তানী করতে না পারে।ঘ. পাকিস্তানী সেনাদের ও তাদের রসদ বহনে ব্যবহার্য যানবাহন, নৌযান, রেলগাড়ি ধ্বংস করে দিতে হবে। ঙ, যুদ্ধপরিকল্পনা এমন ভাবে করতে হবে যাতে শত্রু ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। চ. তাদের বিচ্ছিন্ন করার পর গেরিলা দলগুলো তাদের উপর মারণঘাতি হামলা চালাবে। জুলাইয়ের সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার দেশের রণাঙ্গণকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে। এগুলো হচ্ছে:১ নং সেক্টর:চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালির কিছুটা (মুহুরি নদীর পূর্বতীর)নিয়ে গঠিত এই সেক্টর বিভক্ত ছিলো ৫টি সাব-সেক্টরে। প্রায় ২১০০ জনের সেক্টর ফোর্সে দেড় হাজার ছিলেন ইপিআর বাহিনীর সদস্য, ২০০ পুলিশ এবং ৩০০ সেনাসদস্য আর বাকিরা নৌ ও বিমান বাহিনীর। এর বাইরে ২০ হাজারের বেশী বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন যাদের মাত্র ৩৫ ভাগ সশস্ত্র ছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমান এই সেক্টরের প্রথম অধিনায়ক, পরে তার জায়গা নেন মেজর রফিকুল ইসলাম। ২ নং সেক্টর:কুমিল্লা, ফরিদপুর, নোয়াখালির কিয়দাংশ ও ঢাকা নিয়ে গঠিত এই সেক্টর বিভক্ত ছিলো আরও ৬টি সাবসেক্টরে। ৪ হাজার সেক্টর সেনা এবং ৩০ হাজার গেরিলার এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর খালেদ মোশররফ, পরে নেতৃত্ব দেন মেজর হায়দার। ৩ নং সেক্টর:মৌলভীবাজার ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কিছু অংশ নারায়ণগঞ্জ এবং কেরানিগঞ্জের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এই সেক্টরে ছিলো দশটি সাবসেক্টর এবং যোদ্ধা ছিলো প্রায় দশ হাজার। মেজর শফিউল্লার এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন পরে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এস ফোর্সের নেতৃত্ব দেওয়া হলে শফিউল্লাহর জায়গা নেন মেজর নুরুজ্জামান। ৪ নং সেক্টর:উত্তরে সিলেট পুলিশ স্টেশন এবং দক্ষিণে হবিগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের মাঝামাঝি অবস্থিত এই সেক্টরের ছিলো ছয়টি সাবসেক্টর।৩ হাজার সেক্টর ট্রুপস আর ৮ হাজার গেরিলার যুদ্ধস্থল এই সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। এই সেক্টরের সদরদফতর প্রথমে রাণীগঞ্জে ছিলো, পরে তা মাসিমপুরে স্থানান্তরিত হয়।৫ নং সেক্টর:সিলেটের উত্তরাঞ্চলে ছয়টি উপসেক্টর নিয়ে গঠিত এই সেক্টরে ছিলো ৮০০ সেক্টর ট্রুপস এবং ৭ হাজার গেরিলা। অধিনায়ক ছিলেন মীর শওকত আলী। ৬ নং সেক্টর: রংপুর দিনাজপুর জেলা নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন উইং কমান্ডার এমকে বাশার। ৫টি সাবসেক্টরে বিভক্ত এই সেক্টরে নিয়মিত বাহিনী ছিলো ১২০০ জনের এবং গেরিলা ছয় হাজার। পাটগ্রামের বুড়িমারি ছিলো এই সেক্টরের সদরদফতর। ৭ নং সেক্টর:রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া এবং দিনাজপুরের কিয়দাংশ নিয়ে গঠিত এই সেক্টর ভাগ ছিলো ৮টি উপসেক্টরে। নিয়মিত বাহিনীর দু হাজার এবং সমসংখ্যক গেরিলার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর নাজমুল হক। এক গাড়ি দূর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর তার জায়গা নেন মেজর কাজী নুরুজ্জামান।৮ নং সেক্টর:কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল পটুয়াখালি নিয়ে প্রাথমিকভাবে গঠিত এই সেক্টর থেকে পরে বরিশাল পটুয়াখালিকে আলাদা করে দেওয়া হয়। ৭টি উপসেক্টরে বিভক্ত এই সেক্টরের সদর ছিলো বেনাপোলে। ২ হাজার সেক্টরফোর্স এবং ৭ হাজার গেরিলার এই রণাঙ্গনে প্রথমে অধিনায়ক ছিলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। ১৫ জুলাই মেজর এমএ মঞ্জুর এর দায়িত্ব নেন এবং ওসমান চৌধুরীকে সদর দফতরে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৯ নং সেক্টর:বরিশাল, পটুয়াখালি এবং ফরিদপুর-খুলনার কিছু অংশ নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের অধীনে ছিলো এক ব্যাটেলিয়ান নিয়মিত সেনা এবং ১৫ হাজার গেরিলা। ৭ টি সাবসেক্টরে বিভক্ত ছিলো এটি যার নেতৃত্বে ছিলেন মেজর এমএ জলিল।
১০ নং সেক্টর:এই সেক্টরের কোনো সীমারেখা ছিলো না। পাকিস্তানী নৌযানগুলোর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাত চালাতে নৌ কমান্ডোরা এই সেক্টরে অপারেশন চালাতেন। নির্দিষ্ট অপারেশনে ওই এলাকার নির্ধারিত সেক্টর কমান্ডারের অধীনস্থ হতেন তারা।
১১ নং সেক্টর: বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা জুড়ে বিস্তৃত এই সেক্টর ভাগ ছিলো ৮ ভাগে যার দায়িত্বে ছিলেন মেজর আবু তাহের। তার অধীনে ছিলো ২০ হাজার গেরিলা। ১৫ নভেম্বর কামালপুরের যুদ্ধে তাহের আহত হলে স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ তার জায়গা নেন।
যেহেতু অস্ত্র ও সাপ্লাইয়ের জন্য ভারতীয় বাহিনীর উপর নির্ভরশীল ছিলো মুক্তিবাহিনী, তাই এটি সুচারুভাবে সারতে প্রতিটি সেক্টরে বাংলাদেশের পাশাপাশি একজন ভারতীয় সেক্টর কমান্ডারও ছিলেন বিএসএফের প্রতিনিধি। তার মাধ্যমেই ভারতীয় বাহিনীর কাছে সাপ্লাই, রেশন এবং অ্যামুনেশনের জন্য আবেদন করতেন বাংলাদেশী সেক্টর কমান্ডার। ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের কমান্ডের অধীনে ছিলো বাংলাদেশের এই ১১টি সেক্টর যা তারা ছয়জন ব্রিগেডিয়ারের অধীনে ভাগ করেছিলো ৬টি জ্যাকপট সেক্টরে। মুক্তিবাহিনীর এক বা একাধিক সেক্টরের প্রশাসনিক এবং অপারেশনের নিয়ন্ত্রণ ছিলো এই জ্যাকপট কমান্ডারদের হাতে। তবে প্রতিটি সেক্টরের যুদ্ধপরিকল্পনা ভারত এককভাবে নিতে পারতো না, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দফতরের সঙ্গে আলোচনা করেই তাদের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আসতে হতো যা বাস্তবায়ন করতেন সেক্টর কমান্ডাররা। আর সেটা তত্বাবধান করতেন জ্যাকপট সেক্টর কমান্ডাররা। ইংরেজি বর্ণমালার এ থেকে এফ পর্যন্ত নামাংকিত এইসব জ্যাকপট সেক্টর দেখতেন ভারতীয় বাহিনীর যেসব অফিসার, তাদের নাম উল্লেখ করছি:১.ব্রিগেডিয়ার জে.সি যোশীর অধীনে ছিলো মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর সেক্টর।২. ব্রিগেডিয়ার প্রেম সিং নিয়ন্ত্রণ করতেন ৭ নম্বর সেক্টরের যুদ্ধ।৩.ব্রিগেডিয়ার এন.এ.সালিক ৮ ও ৯ নম্বর সেক্টরের দেখভাল করতেন। ৪.ব্রিগেডিয়ার শাবেগ সিংয়ের নিয়ন্ত্রণে ছিলো ১,২ ও ৩ নম্বর সেক্টর।৫.ব্রিগেডিয়ার এম.বি.ওয়াড়কে দেখতেন ৪ নম্বর সেক্টর, তার ই সেক্টরকে ই-ওয়ান নামে বিভক্ত করে ৫ নম্বর সেক্টর দেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো লে.কর্নেল ভিএন রাওকে এবং পরে সে দায়িত্ব পালন করেন ব্রিগেডিয়ার কে লাখপত সিং।৬.ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংয়ের অধীনে ছিলো ১১ নম্বর সেক্টর।
২৫টি যুব ক্যাম্পের মাধ্যমে আগ্রহীদের মধ্য থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বাছাই করা হতো। ১হাজার তরুণ যুবকের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এসব ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলো ভারতীয় পুনর্বাসন মন্ত্রনালয়। এদের মধ্য থেকে রাজনৈতিক আনুগত্য যাচাই বাছাই করে তারপর তাদের নেওয়া হতো। প্রচুর পরিশ্রম, মানসিক বিপর্যস্ততা, পারিবারিক সমস্যার কারণে কিছু ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষন ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘটনা আছে। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে শরণার্থী শিবিরের সক্ষম তরুণ যুবকদের যুদ্ধে অনাগ্রহ। লাখখানেক মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে শরণার্থী শিবির থেকে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার শতকরা হারটি লজ্জাজনকভাবে এক ভাগেরও কম। আবার দেশ থেকে অনেক দূর্গম পথ পাড়ি দিয়ে ক্যাম্পে এসেও প্রশিক্ষণের জন্য সুযোগ পাচ্ছিলেন না অনেক বাঙালী তরুন। আগরতলা ক্যাম্পে এমন একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় যেখানে তিন হাজার তরুণ সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য দুমাস ধরে অপেক্ষায় আছেন মানবেতর পরিবেশে। আরেকটি সমস্যা ছিলো ছাত্রদের মধ্যে। রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন এই ছাত্ররা একেকজন মাও সেতুং কিংবা চে গুয়েভারা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকলেও বাস্তবতা তাদেরকে নাড়া দিয়ে যায়। একেকজনের রাজনৈতিক আনুগত্যের বিভিন্নতাও সমস্যা সৃষ্টি করে যখন একজন আরেকজনের নেতৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানায়। আওয়ামী লীগ নেতাদের কঠোর হস্তক্ষেপে অবশ্য এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়।সে তুলনায় চাষাভুষা গ্রামের সাধারণ ছেলেরা অনেক বেশী ঝামেলাহীন। তারা রাজনীতি নিয়ে ঝগড়া করেনি, জাঙ্গলবুটের জন্য ঝগড়া করেনি। ছেড়া গেঞ্জি গায়ে লুঙ্গি মালকোচা মেরে জয় বাংলা বলে যুদ্ধ করে গেছে।
প্রাথমিকভাবে ভারত ছয়টি প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে ছয় জ্যাকপট কমান্ডারের তত্বাবধানে। এগুলো ছিলো মুরতি (পশ্চিমবঙ্গ), রায়গঞ্জ(পশ্চিমবঙ্গ), চাকুল্য(বিহার) ,দেওটামুরা (ত্রিপুরা), মাসিমপুর (আসাম), তুরা (মেঘালয়)। এসব ক্যাম্প থেকে প্রতিমাসে ১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হতেন। পাশাপাশি ই-ওয়ান সেক্টরের অধীনে ছিলো ঝারিনপুর (মেঘালয়) যেখান থেকে বের হতেন ৫০০ জন। প্রতি ১০০জন প্রশিক্ষনার্থীর জন্য ছিলেন একজন অফিসার, ২জন জেসিও এবং ৫ জন ননকমিশনড অফিসার। চার সপ্তাহের এই প্রশিক্ষণে অস্ত্র চালনার পাশাপাশি, রেকি, এমবুশ, বুবি ট্র্যাপ এবং রেডিও সিগনাল পাঠানো শেখানো হতো। আগস্ট মাসে এই প্রশিক্ষণের সময়সীমা কমিয়ে তিন সপ্তাহ করা হয়।
নভেম্বরের শেষ দিকে যখন বাংলাদেশ ভারত যৌথ বাহিনী গঠন করা হচ্ছে তখন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা প্রায় ৮৩ হাজার আর তাদের মধ্যে ৫১ হাজারই দেশের ভেতরে যুদ্ধ করছেন। একশো থেকে দেড়শো জন নিয়ে গঠিত হতো মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ। তাদের বিশজনের স্কোয়াড এবং দশজনের টিমে বিন্যস্ত করা হতো। প্রতি টিমে থাকতো চারটি থ্রিনটথ্রি রাইফেল, দুটো এসএলআর, তিনটি স্টেনগান এবং একটি এলএমজি। প্রতি মুক্তিযোদ্ধা মাথা পিছু দুটো করে গ্রেনেড পেতেন এবং পর্যাপ্ত বিস্ফোরক। মুরতি ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বা স্বাধীন বাংলা রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাচের ১৩০ জন ক্যাডেট অফিসারকে তিন মাসের ট্রেনিং দেওয়া হয় যাদের অন্যতম ছিলেন শেখ কামাল। এছাড়াও ৫০০ জন যুবককে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যাতে তারা নিজেরাই প্রশিক্ষণ দিতে সক্ষম হয় যুদ্ধে আগ্রহী কিন্তু ভারতে আসতে না পারা তরুণদের। এর বাইরে ১২০০ যুবককে মেডিকেল ট্রেনিং দিয়ে মেডিকেল কিটসহ পাঠানো হয় দেশে।
এখানে মনে রাখতে হবে গণবাহিনীর সদস্য বা বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন একধরণের স্বেচ্ছাসেবক। কিন্তু নিয়মিত এবং আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন পেশাদার। তাই তাদের জন্য বেতন বরাদ্দ ছিলো বাংলাদেশ সরকারের তরফে। জ্যাকপট কমান্ডারের মাধ্যমে প্রতিমাসে এই বেতন পেতেন তারা যা ছিলো এরকম:কমান্ডিং অফিসার : ৫০০ ভারতীয় রুপিঅফিসার: ৪০০ রুপিঅফিসার ক্যাডেট: ১০০ রুপিজুনিয়র কমিশনড অফিসার (জেসিও): ১৫০ রুপিমুক্তিফৌজের নন কমিশনড অফিসার এবং নিয়মিত বাহিনীর সাধারণ সৈন্যদের বেতন ছিলো যথাক্রমে ৭০ ও ৭৫ রুপি।অন্যদিকে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ কালে ৩০ রুপি এবং ট্রেনিং শেষে ৫০ রুপির এককালীন ভাতা পেতেন। দেশে পাঠানোর সময় দিন হিসাব করে তাদের জন্য বরাদ্দ ছিলো প্রতিদিন ২ রুপি।বেতনের পাশাপাশি দুই সেট খাকি ইউনিফর্ম এবং হালকা বিছানা পেতেন নিয়মিত বাহিনীর সদস্যরা। আধাসামরিক বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা পেতেন লুঙ্গি, শার্ট, পিটি স্যু। এর বাইরে স্থানীয় সূত্র থেকে কম্বলসহ থালাবাসন ইত্যাদি জোগাড় করে নিতেন তারা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতো একই রেশন বরাদ্দ ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা অনুযায়ী অস্ত্রের সংখ্যা ছিলো অপ্রতুল। এই সমস্যার কারণ হচ্ছে ভারতীয় বাহিনীর অর্ডন্যান্স থেকে এসব অস্ত্র ইস্যু করে তারপর আকাশপথে নিয়ে যেতে হতো প্রয়োজনীয় জায়গায়।সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক এই জটিলতায় হতাশায় ভুগতে হতো মুক্তিযোদ্ধাদের।
বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকগুলো ভাগ ছিলো যাদের মধ্যে ব্যতিক্রমী কিছু হচ্ছে: 
  1. সুইসাইড স্কোয়াড:মূলত জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম লীগের দালাল নেতাদের হত্যা করাই ছিলো এদের মিশন। পাশাপাশি রাজাকার এবং পাকিস্তানীদের সহযোগী দালাল বাঙালী কর্মকর্তারাও ছিলো তাদের হত্যা তালিকায়। এদের উপর নির্দেশনা থাকতো গ্রেফতার এড়াতে আত্মহত্যার। 
  2. বিচ্ছু বাহিনী:মূলত অল্পবয়সী কিশোর এবং বালকদের নিয়ে গঠিত হতো এই বাহিনী যাদের কাজ ছিলো মুলত গোয়েন্দার। এরা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনীর গতিবিধি নজর রাখতো এবং ক্যাম্প ও বাংকারগুলোর খুটিনাটি তথ্য যোগাড় করতো। ঢাকা ও চট্টগ্রামে মেয়েদের উইং ছিলো বিচ্ছু বাহিনীর। এদেরই একজন শহিদুল ইসলাম লালু বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বীরপ্রতীক যিনি গ্রেনেড হামলায় দুটো পাকি বাংকার উড়িয়ে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সহজ করে দিয়েছিলেন থানা দখল। 
  3. তুফান বাহিনী ছিলো বিশেষ কমান্ডো ট্রেনিং পাওয়া বাহিনী যারা ঝড়ের মতো এসে কাজ সেরে সেভাবেই হাওয়া হয়ে যেতেন। মুক্তিবাহিনীর এই গেরিলাযোদ্ধাদের তৃণমূল পর্যায়ের সার্বিক সহযোগিতা দিতো সংগ্রাম পরিষদ। প্রতিটি থানা ও মহকুমা পর্যায়ে একাত্তরের শুরুতেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিলো এই সংগ্রাম পরিষদ যারা মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া আশ্রয় এবং নিরাপত্তার দিকটা দেখতো।
ভারতীয় বাহিনীর অস্ত্র সহায়তা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই দেশের ভেতর সাফল্যের সঙ্গেই মুক্তিযুদ্ধ চালিয়েছে কিছু সাহসী তরুণ-যুবা যাদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হচ্ছে মাগুরার আকবর বাহিনী (প্রায় দেড় হাজার গেরিলা),যশোর ও খুলনা অঞ্চলে হেমায়েত বাহিনী (৫০০ গেরিলা) খিজির ও রিয়াসাত বাহিনী (১০০ যোদ্ধা),ক্যাপ্টেন জিয়ার বাহিনী (২৫০ জন), শাহজাহান বাহিনী (২৫০ যোদ্ধা),আরেফিন বাহিনী (যোদ্ধা সংখ্যা জানা যায়নি), মেহেদি বাহিনী (৭৫জন গেরিলা); ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম অঞ্চলে নুরুল আফসার বাহিনী (৪০০ জন), হারুন (১০০ জন);ময়মনসিংহ অঞ্চলে কাদেরিয়া বাহিনী (প্রায় ১৭ হাজার), আবদুল মান্নান (৮৫ জন), আনোয়ারউদ্দিন (১০০ জন)। এদের বেশীরভাগই পরে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর আনুগত্য মেনে নেয়।
চীনপন্থী যেসব বাম মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বরিশালের পেয়ারাবাগান অঞ্চলে সিরাজ শিকদারের বাহিনী,পাবনায় টিপু বিশ্বাসের বাহিনী,মতিন-আলাউদ্দিন বাহিনী, আবদুর হকের বাহিনী, নোয়াখালি অঞ্চলের কমরেড তোয়াহার লালবাহিনী এবং ফকিরহাট-মিরেরসরাই সীতাকুন্ড অঞ্চলের কাশেম বাহিনী। পাকিস্তানের প্রতি চীনের প্রকাশ্য পক্ষপাতে এরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধকে এরা সোভিয়েত সম্প্রসারনবাদ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের মেলবন্ধন অভিধা দিয়ে কেউ যুদ্ধ বন্ধ করে দেয় (মতিন- আলাউদ্দিন), কেউ বা পাকিস্তানের পক্ষ নেয় (আবদুল হক), কেউ পাকিস্তানি ও মুক্তিবাহিনী দুইপক্ষের সঙ্গেই যুদ্ধ করে (সিরাজ শিকদার, তোয়াহা, কাশেম)। এর বিপরীতে কমরেড ওহিদুল তার দেড়হাজার যোদ্ধা নিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বীকার করে নেন। একইভাবে অগ্নিপ্রভা মিথি তার মিথি বাহিনী নিয়ে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করেন। এর বাইরে আরো দুটো চীনপন্থী গ্রুপের কথা না বললেই নয়। কাজী জাফর ও মেনন গ্রুপ মুক্তিবাহিনীর পক্ষ নিলেও মশিউর রহমান-নুরুল কাদির-হুদা গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধকে দুই কুকুরের লড়াই বলে এতে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে।
এছাড়া মুজিব বাহিনীর কথা না বললেই নয় ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা এই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়।মুক্তাঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক আধিপত্য নিশ্চিত করতে তৈরি হয়েছিলো এই এলিট বাহিনী যাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে তৈরি করা হচ্ছিলো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য। এদের বেশিরভাগ যুদ্ধ করতে পারেননি, বরং স্বাধীনতার পর তাদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ কাজে লাগান জাসদ ও গণবাহিনী গঠন করে। মুজিববাহিনী গঠনের পর মস্কোপন্থী বামেরা অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের নেতৃত্বে ২০ হাজার সদস্যের একটি পৃথক দল গঠন করে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। ঘোড়াশাল, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, নরসিংদি, কুমিল্লা ও ঢাকা অঞ্চলেই মূলত যুদ্ধ করে তারা। এছাড়া ঢাকা তোলপাড় করা ক্র্যাকপ্লাটুনের বেশীরভাগ সদস্যই ছিলো মস্কোপন্থী বাম বা ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য।
এবার আসা যাক নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে গড়া স্বাধীন বাংলা রেজিমেন্টের বিষয়ে। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ১, ৩ ও ৮ নং ব্যাটেলিয়নকে মেঘালয়ের তুরায় পাঠানো হয়।সেখানে তাদের পুনর্বিন্যস্ত করা হয়।একইভাবে ত্রিপুরায় অবস্থিত ২ ও ৪ নং ব্যাটেলিয়নকে বিন্যস্ত করা হয়। সেপ্টেম্বরে আরও তিনটি নতুন ব্যাটেলিয়ন গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। প্রশিক্ষিত গেরিলা, জুনিয়র ক্যাডেট অফিসার এবং বাকি পাচ ব্যাটেলিয়ন থেকে বাছাই করে নভেম্বরের শেষ নাগাদ গঠিত হয় আটটি পদাতিক বাহিনী যারা ছিলো যুদ্ধউপযোগী এবং সমরাস্ত্রে সজ্জিত। যদিও নতুন তিন ব্যাটেলিয়ান যুদ্ধের জন্য পূর্ণাঙ্গ প্রস্ততির মতো প্রশিক্ষণ পায়নি।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা গোলন্দাজ বাহিনীর ৮০ জন বাঙালী সদস্যকে নিয়ে ত্রিপুরায় গঠিত হয় মুজিব ব্যাটারি নামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ফিল্ড ব্যাটারি। তাদের দেওয়া হয় চারটি ৩.৭ ইঞ্চি হাওইটজার গান। অক্টোবরে শিলচরে দ্বিতীয় ফিল্ড ব্যাটারিটি সংগঠিত হয় ছয়টি ১০৫ এমএম ইটালিয়ান গান সহকারে।পরে এই অস্ত্রসম্ভার দুভাগ করে আরেকটি ফিল্ড ব্যাটারি গঠন করা হয়। নভেম্বরের শেষ নাগাদ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আটটি ব্যাটেলিয়ান তিনটি ব্রিগেড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অধিনায়কদের নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে তাদের নাম হয় যথাক্রমে জেড ফোর্স (জিয়াউর রহমান), এস ফোর্স (সফিউল্লাহ)এবং কে ফোর্স (খালেদ মোশাররফ)। জিয়ার জেড ফোর্সে ছিলো ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১,৩ ও ৮ নং ব্যাটেলিয়ন এবং ২ ফিল্ড ব্যাটারি। ১০ ও ১১ নং ব্যাটেলিয়ান এবং তিনটি ইটালিয়ান ১০৫এমএম গান নিয়ে গঠিত তিন ফিল্ড ব্যাটারির কমান্ড পান খালেদ মোশাররফ। সফিউল্লাহর এস ফোর্সে ছিলো ২,৩,৯ নং ব্যাটেলিয়ান এবং ১ নং ফিল্ড ব্যাটারি। পাশাপাশি ৫৫০ জন নৌকমান্ডোকে নিয়ে এবং পাকিস্তান নৌ বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা কিছু নৌঅফিসার ও সেনাকে নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনী। অক্টোবর নাগাদ দুটো হেলিকপ্টার এবং একটি করে ওটার ও ডাকোটা বিমান নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। দুটো বিমানেই রকেট এবং মেশিনগান সংযুক্ত এবং তা থেকে বোমা নিক্ষেপ করা যেতো। ইপিআর পুলিশ আনসারের মতো আধাসামরিক বাহিনীর ৯ হাজার ৬৬০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত মুক্তিফৌজকে ৪৫টি কোম্পানিতে ভাগ করে বিভিন্ন সেক্টরে বিন্যস্ত করে দেওয়া হয় নিয়মিত বাহিনী এবং গেরিলাদের সঙ্গে।
২০ নভেম্বর রোজার ঈদের পর থেকেই ঘুরে যায় যুদ্ধের মোড়। ভারতীয় সেনাবাহিনী অনেকটা প্রকাশ্যেই আর্টিলারি সাপোর্ট দিতে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের।সেই সুবিধা নিয়ে দেশের বিস্তির্ণ অঞ্চলে পাকিস্তানীদের বিচ্ছিন্ন এবং কোনঠাসা করে ফেলে মুক্তিবাহিনী। জাতিসংঘ ও পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপে পূর্ব পাকিস্তানকে বাচানোর শেষ প্রয়াস হিসেবেই ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করে পাকিস্তান। লড়াই শুরু হয়ে যায় দুই ফ্রন্টে। পুর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ ভারত মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে শুরু হয় কনভেনশনাল ওয়ার। ইতিমধ্যে আকাশ এবং নৌপথ জেতা হয়ে গেছে তাদের।স্থলপথের পুরোটাই সহজ এবং নিরাপদ করে রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধারা। ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নিলো আরাধ্য বাংলাদেশ, যার জন্য এত সংগ্রাম, এত রক্ত, এত ত্যাগ।
মাত্র সাড়ে চারহাজার পাকিস্তানী মারা নিয়ে হতাশ হবেন না প্লিজ। মনে রাখবেন নিয়মিত বাহিনীর প্রশিক্ষিত সেনা অফিসাররা এই অসীম সাহসী আবেগীদের একটু গুলি ছুড়তে শিখিয়ে মরতে পাঠিয়ে দিয়েছে প্রাথমিক ঝামেলা সেরে যুদ্ধটা তাদের জন্য একটু নিরাপদ করতে। আসল কাজটা এরাই সেরেছে। এদের জন্যই মনোবলের তলানীতে পৌছানো পাকিস্তানীরা সুযোগ পাওয়া মাত্র সাদা পতাকা উড়িয়েছে। মনে পড়ছে ২০০৮ সালের ৩০ মার্চ জেনারেল জ্যাকবের নেওয়া সাক্ষাতকারের শেষ কথাগুলো:

Last of all, I want to tell you something. The freedom fighters and the East Bengal Regiment, who with their limited resources fought a mighty regular army, earned the liberation of Bangladesh and it was their love for the country that made them victorious. We helped them, we were brothers in arms. But it was their fight, they fought it. They fought with passion and they achieved what they fought for. I give my heartiest blessings and share the pride for them. They are the gems your country should be proud of.

হেল আম প্রাউড অব দেম ম্যান। আই চেরিশ দেয়ার প্রাইড…

এরিক প্রিবক বনাম গোলাম আযম



এরিক প্রিবকের জন্ম ১৯১৩, মৃত্যু ২০১৩। বেঁচে ছিল পুরা একশ বছর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যাটা ছিল এসএস পুলিশ বাহিনীর কাপ্তান। যুদ্ধের সময় গুনেগুনে ইতালির ৩৩৫ জন সাধারণ নাগরিককে হত্যার মূল কাণ্ডারি ছিলেন তিনি। ২৩শে মার্চ ১৯৪৪ এ ইতালিতে জার্মান বাহিনী স্থানীয়দের প্রতিরোধের মুখে পড়ে। খণ্ড যুদ্ধে মারা যায় ৩২ জন জার্মান সেনা । হিটলারের কাছে খবর যাওয়া মাত্রই নির্দেশ আসে, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে প্রতি একটা জার্মান লাশের বিনিময়ে দশটা লাশ নামাতে। প্রিবকের উপর দায়িত্ব পরে ৩২০ জনের তালিকা করার। যুদ্ধ করে ৩২০ জনের লাশ না, জেলে বন্দী ইতালীয় নাগরিকদের দিয়ে তালিকা বানানো হয়। তালিকা করতে করতে আরও এক জার্মান সেনার মৃত্যু ঘটে। ৩২০ জনের তালিকাও বেড়ে ৩৩০ করতে হয় হিসেব মতো। জেলে বন্দী লোক দিয়ে তালিকা পূরণ না হওয়াতে বাসায় থাকা সাধারণ নাগরিকদের তালিকাতে ঢুকানো হয়। ৩৩০ জনের তালিকায় স্থানীয় যোদ্ধার সংখ্যা খুবই কম ছিল। বরং বেশিরভাগই বাসা থেকে জেরা করতে অথবা তেমন কোন কারণ ছাড়াই ধরে আনা কিশোর তরুণ বা বৃদ্ধ সাধারণ মানুষ। পরদিন যা হয় তা "Ardeatine caves massacre" নামে কুখ্যাত। বন্দীদের শহরের কাছে এক গুহাতে নিয়ে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। প্রতি ধাপে পাঁচজন করে গুহাতে ঢুকানো হয়, গুলি করা হয়। একের পর এক দলকে ঢুকিয়ে একইভাবে চলতে থাকে। লাশের স্তূপ জমতে থাকে। হিসেবের কিছু গরমিল হয়ে দেখা যায় ৩৩০ জনের বদলে ৩৩৫ জনকে নিয়ে আসা হয়েছে। যাহা ৫২ তাহা তিপ্পান্ন বলে ওই ৩৩৫ জনকেই হত্যার নির্দেশ দেয় প্রিবকে। নিজ হাতে মারেন দুই জনকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রিবকে পালিয়ে চলে যান আর্জেন্টিনা। পাপ ঢাকতে ধর্মের গোসলের চেয়ে বড় গোসল আর নেই। প্রিবকে আবার নতুন করে ব্যাপ্টিজমে দীক্ষা নেয়। চার্চের এক বিশপের সাহায্যে পালায় আর্জেন্টিনাতে। সেখানে মুক্ত মানব হয়ে ঘুরে এক দুই বছর না, টানা পঞ্চাশ বছর! সব কিছু ভালোই চলছিল, লোকে তাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। প্রিবকে বিপদে পড়লো ১৯৯৪ সালে এবিসি চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে। সাক্ষাৎকারে খোলাখুলি কথা বলে সে, কিভাবে সব হল, কিভাবে নির্দেশ আসলো আর সে হত্যা করলো ৩৩৫ জন মানুষকে। তার কথায় কোন অনুতাপ নেই, কৃতকর্মের জন্য কোন অনুশোচনা নেই, কোন আবেগ নেই। তার এই নিরাবেগ সাক্ষাৎকার দেখে অনেক মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়লো। শুরু হল তাকে ইতালিতে ফিরিয়ে এনে বিচার করার জন্য আন্দোলন। প্রিবকের পক্ষের উকিল আর বন্ধুরা শুরু করলো নানা টালবাহানা। তারা একবার অজুহাত দেখায় যেহেতু এতদিন তার বিচার হয়নি তাই তার সব অপরাধ তামাদি হয়ে গেছে। আবার অজুহাত দেখায় সমস্ত কাগজপত্র আগে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করে দিতে হবে তারপর তাকে ইতালিতে ফিরিয়ে আনার আলাপ হবে। সতের মাস নানা টালবাহানা সামলানোর পর অবশেষে আর্জেন্টিনা সরকার প্রাইবকেকে ফেরত পাঠায় ইতালিতে। শুরু হয় বিচার।

তারপর এক বিরাট ইতিহাস। সেই একই রকম ইতিহাস। বিচার হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, আন্তর্জাতিক ইত্যাদি ইত্যাদি তামাশা। প্রথম ধাপে প্রিবকে বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। কারণ দেখানো হয় সে হিটলারের আদেশ পালন করছিল মাত্র। কোর্ট হাউজের সামনে শুরু হয় বিক্ষুব্ধ জনতার আন্দোলন। প্রসিকিউটদের আপিলে আবারও তাকে হাজির করা হয় কোর্টে। নিজ হাতে যেই দুইজনকে মারেন সেই হত্যার জন্য এবার বিচার হয় তার। সেইসাথে হিটলারের নির্দেশ অনুসারে ৩৩০ জনের জায়গায় মারা হয় ৩৩৫জনকে, সেই পাঁচজন হত্যার দায় প্রিবকের উপর বর্তায়। দুই বছরের বিচারকার্য শেষে প্রাইবকেকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। বয়সের অজুহাত দেখিয়ে সেই পনের বছরকে দশ বছর করা হয়। আবারও শুরু হয় জনরোষ। আপিলের পর এবার ১০ বছরের জায়গায় তাকে যাবজ্জীবন দেয়া হয়, তবে কারাদণ্ড নয় আরামদণ্ড! বয়সের অজুহাত দেখিয়ে তাকে জেলে না রেখে গৃহবন্দী করার আদেশ হয়।

ক্ষুব্ধ জনগণের আন্দোলন আর প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায় প্রিবকের জীবন। ২০০৭ সালে কোর্ট প্রিবকে কে কাজ করার জন্য বাড়ি থেকে বের হবার অনুমতি দেয়! জনগণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে কোর্ট আদেশ বদল করে আবার তাকে গৃহবন্দী করে। এরই মাঝে একদিন প্রিবকে একদিন সেঞ্চুরি পূরণ করে ফেলে। একশতম জন্মদিনে তার নাতি তাকে শ্যাম্পেন উপহার দিতে গিয়ে আবার পাবলিকের রোষের মুখে পড়ে। লোকজন আস্তে আস্তে অনেকে প্রিবকে কে ভুলে যায়। অনেকে ভুলতে পারেনা। অক্টোবর ২০১৩ তে প্রিবকের মৃত্যু হয়। সহজ সাধারণ বয়স জনিত মৃত্যু। তার শেষ ইচ্ছা ছিল তাকে যেন তার আর্জেন্টিনাতে তার স্ত্রীর পাশে সমাহিত করা হয়। আর্জেন্টিনা সরকার তার লাশ ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করে। তার জন্ম যেই দেশে সে জার্মানিও তার লাশ নিতে রাজী হয়না। ভ্যাটিকান নিষেধাজ্ঞা জারি করে কোন ক্যাথোলিক চার্চে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করার প্রতি। বিচ্ছিন্ন এক ছোট ক্যাথোলিক গ্রুপ তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে রাজী হয়।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় আবার শুরু হয় প্রতিবাদ। প্রিবকের প্রতি সহানুভূতিশীল গ্রুপের সাথে এতদিন ধরে প্রাইবেকের বিচার চেয়ে আসা গ্রুপের গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। গণ্ডগোলের মুখে শেষ পর্যন্ত প্রিবকের পরিবারের কেউ তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যোগ দেয়ার সুযোগ পায়না। প্রতিবাদকারীদের একটাই দাবী, প্রিবকের লাশ ইতালির বুকে রাখা যাবে না। প্রচণ্ড রায়ট শুরু হয়ে যাওয়াতে ইতালি সরকার প্রিবকের লাশ সরিয়ে নিয়ে যায় মিলিটারি বেইজের ভেতর। শেষপর্যন্ত প্রিবকের লাশ কি সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয় না পুড়িয়ে দেয়া হয় না অন্য কিছু তা জানার উপায় নেই। সরকার জানিয়ে দেয় প্রিবকে কে এক অজানা স্থানে কবর দেয়া হয়েছে। সেই অজানা স্থান কোথায় সেটা তার পরিবারের কাউকেও জানানো হয়নি।

আমি উইকিপিডিয়াতে প্রিবকের এই কাহিনী বসে বসে পড়ি আর হাসি। প্রিবকের ট্রায়াল নিয়ে অনেক ইতালিয় নাগরিক এখনও ক্ষুব্ধ, ন্যায় বিচার পাওয়া যায়নি বলে। মন চায় ইতালিয়দের গিয়ে ওই জোকটা বলে সান্ত্বনা দেই, জঙ্গলে গিয়ে বানর দলের হাতে আটকা পড়ছে তিন লোক। তিনজনকে আদেশ করা হল জঙ্গলে গিয়ে কোন একটা ফল নিয়ে আসতে। প্রথমজন লিচু নিয়ে আসলো, বানর রাজ সেই লিচু ভরলো ওই লোকের ইয়েতে, দ্বিতীয়জন আম নিয়ে আসলো তার একই পরিণতি হল। কিন্তু দুইজনেই দাঁত কেলিয়ে খুশিতে হাসতে লাগলো। বানর রাজ ঝাড়ি দিয়ে বলল ব্যাটারা হাসস কেন। বলে আমরা আসার সময় দেখলাম তৃতীয়জন হেলতে দুলতে কাঁঠাল নিয়ে আসতেছে, এই দেখে হাসি।

এরিক প্রিবকে যদি লিচু হয় তবে গোলাম আযম কাঁঠাল। নাহ শুধু কাঁঠাল না, রীতিমতো কাঁঠাল গাছের বাগান। এরিক প্রিবকের বাপ এসে আমাদের আস্ত কাঁঠাল বাগান পুরে দিয়ে গেল। কত কত ৩৩০ এর তালিকা করে গেল, প্ল্যান করে গেল, মেরে গেল। তারপর প্রায় সেঞ্চুরি পূরণ করে বিছানায় বসে স্যুপ খেতে খেতে মরে গেল। এখন হয়তো অতীতের কথা ভুলে সামনে এগিয়ে যাবার আহ্বান আসবে। বিভক্তি ভুলে দেশের জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার উপদেশ আসবে। গুরুজনকে সম্মান করার কথা আসবে। গালিগালাজ না করে যুক্তি দিয়ে মিষ্টি করে কথা বলার আহ্বান আসবে। ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা আসবে। সবাই বছর খানেকের মধ্যে গোলাম আযমের কথা ভুলে যাবে। কিন্তু গুটি কয়েক মানুষ হয়তো কখনোই ভুলতে পারবে না।

তিনশ কে দশ দিয়ে গুন করলে হয় তিন হাজার, একশ দিয়ে গুণ করলে তিরিশ হাজার, এক হাজার দিয়ে গুণ করলে তিন লাখ, দশ হাজার দিয়ে গুণ করলে তিরিশ লাখ।

গোলাম আযম কোন এরিক প্রিবকে ছিল না। গোলাম আযম হিটলার ছিল। গোলাম আযম কারো নির্দেশে হত্যা করেনি। তার নির্দেশে হত্যা হয়েছে। একশ দুইশ তিনশো হত্যা না, লাখের পর লাখ। চারিদিকের সুশীলেরা রক্ত পরিষ্কারের জন্য, ময়লা পরিষ্কারের জন্য এখন বিবৃতি দিয়েই যাবে দিয়েই যাবে। বলবে, মৃত্যু সবকিছুর ঊর্ধ্বে। মৃত মানুষের কোন পাপ থাকে না। কেউ বলবে, ঘৃণার চাষ করে কোন লাভ হয়না। ঘৃণা ফেলে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

শুধু অল্প কিছু মানুষ সেই ঘৃণা নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকবে। অল্প কিছু মানুষ জানবে মৃত্যুতে কোন বদল হয়না। শুয়োর মরলে মানুষ হয়ে যায়না, শুয়োরই থাকে।

রোগের নাম ‘নার্সিসিজম’ – আক্রান্ত অনেকেই

'নার্সিসিজম’ সম্পর্কে এখন অনেকেই বেশ অবগত। অন্তর্জালে এ বিষয়ক তত্ত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্য আপনার আগ্রহকে উষ্কে দেবার জন্য যথেষ্ঠ। মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী এটি এক ধরনের অসুস্থ্যতা, যার কিছু সুস্পষ্ট লক্ষণ ব্যক্তির আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তবে আচরণগত এসব বৈশিষ্ট্যের বেশ কয়েকটি আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই আছে। কিন্তু সেটা রোগলক্ষণ কিনা তা নির্ভর করে এসবের মাত্রার উপর। তার আগে নার্সিসিজম আসলে কী তা জানা জরুরী। তবে সবার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক গ্রিক পুরাণের দেব-দেবীর কাহিনীর সাথে ‘নার্সিসিজ্‌ম’ শব্দের সম্পর্কটি জেনে নেয়া যাক।
স্বর্গরাণী হেরাকে কথায়-গল্পে মাতিয়ে রাখতো তাঁর আজ্ঞাবহ প্রকৃতি দেবী একো। দারুন মজার এসব দীর্ঘ গল্প শুনে হেরা ভীষণ মুগ্ধ হতেন। আর এভাবেই কেটে যেতো অনেক সময়। এই ফাঁকে তার ভাই ও স্বামী দেবরাজ জিউস প্রমোদে মত্ত হতেন পাহাড়ে, জঙ্গলে থাকা অন্য দেবীদের সাথে। এক সময় স্বামীর এসব কীর্তি সম্পর্কে হেরা আঁচ করতে পারলেন এবং ক্ষুব্ধ হলেন একোর উপর। কারণ কৌশলী একোই তাকে গল্প শোনায় ব্যস্ত রেখে জিউসের এইসব রতিলীলার সুযোগ করে দিয়েছে। তাই শাস্তিস্বরূপ হেরা একো’র কথা বলার শক্তি কেড়ে নিলেন। এখন শুধু অন্যের কথার শেষটুকু প্রতিধ্বনি করতে পারে সে। এদিকে ঘটলো আরেক কাহিনী। নদী-দেবতা কিফিসস-এর ছেলে নার্সিসাস হরিণ শিকারে বেরিয়েছেন। দুপুর রোদে দুরন্ত এক হরিণকে ধাওয়া করার এক পর্যায়ে একো’র নজরে পড়েন তিনি। নার্সিসাসের প্রেমে উতলা হয়ে একো নিজেকে নিবেদন করে তার কাছে। আত্ন-অহংকারী নার্সিসাস প্রত্যাখান করেন একোকে। আর এতে প্রতিশোধের দেবতা নেমেসিস রেগে গেলেন। আর শাস্তি দিলেন এই অহংকারীকে। কী সেই শাস্তি? শিকারের পেছনে ছুটে ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত নার্সিসাস এক ঝর্ণার কাছে এলেন। ঝর্ণার পানিতে নিজের প্রতিকৃতি দেখে এমনই সম্মোহিত হলেন যে, ওখানেই পড়ে রইলেন। তিনি বুঝতেই পারলেননা যে এটা তার নিজেরই চেহারা। একসময় ওখানেই ডুবে মরলেন। আর ওই জলের ধারে জন্ম নিলো ফুলের এক গাছ। ফুলের নাম নার্সিসাস। পুরানের এই ঘটনা থেকেই ইংরেজি নার্সিসিজম শব্দের জন্ম। এর মানে নিজের মধ্যে একান্ত অভিনিবিষ্টতা, নিজের সৌন্দর্য আর সক্ষমতার অতিশায়িত অনুভূতি যা নিজের প্রতি নিমগ্নতা তৈরি করে। এক কথায় একে অতিশয় আত্নপ্রেম বলা যেতে পারে।  বিজ্ঞানীরা আরেক নতুন কথা শুনাচ্ছেন এখন। সেটি হলো, ঘণ্টায় ঘণ্টায় যারা ফেইসবুকে সেলফি আপলোড করেন তারাও নাকি এক ধরণের নার্সিসিস্ট!

নার্সিসিজম রোগের কেতাবি ‘নাম নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজওর্ডার’ বা ‘এনপিডি’।বাংলায় বলা যেতে পারে ‘অতি আত্ম-প্রেম জনিত ব্যক্তিক আচরণ বিচ্যুতি’। এটিকে শুধু রোগ নয়, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক সমস্যা হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।মানুষের প্রধান তিন ধরণের নেতিবাচক ব্যক্তিত্বের (dark triad) অন্যতম হলো এই নার্সিসিজম। অন্য দুটি ধরণ হলো ম্যাকিয়াভিলিয়ানিজ্‌ম এবং সাইকোপ্যাথি।  তবে নিজের প্রতি সম্মানবোধ বা নিজের পারদর্শীতার উপর আস্থা কিংবা নিজের অর্জনের প্রতি ভালোবাসাজনিত সাধারণ যে অহম, যা প্রত্যেকেরই থাকে এবং থাকা উচিৎ, তা কিন্তু নার্সিসিজম তথা এনপিডি নয়। এই অক্ষতিকর ব্যক্তিত্ববোধকে ফ্রয়েড নাম দিয়েছেন প্রাইমারি নার্সিসিজম। অবশ্য বিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এটি ‘হ্যাল্‌দি নার্সিসিজম’ অর্থাৎ ‘স্বাস্থ্যকর আত্ন-প্রেম’ নামে পরিচিত হতে শুরু করে।
নার্সিসিস্টিক পারসোনালিটি ডিজওর্ডার (এনপিডি)-এ আক্রান্তদের মধ্যে নিচের সবগুলো বা বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়ঃ
  • আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগ/সম্পর্কের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট আত্মকেন্দ্রিকতা
  • টেকসই সাবলীল সম্পর্কের ক্ষেত্রে সমস্যা
  • মনস্তাত্বিক সচেতনতার অভাব 
  • অন্যের অনুভূতির বিষয়ে যৌক্তিক ধারণার অভাব
  • নিজেকে অন্যের তুলনায় সর্বদা উচ্চতর অবস্থানে দেখা
  • যেকোন অবমাননা বা কল্পিত অবমাননার প্রতি অতি সংবেদনশীলতা
  • অপরাধবোধে নয়, বরং লজ্জায় বেশি কাতরতা
  • অসৌজন্যমূলক এবং অবন্ধুসুলভ দেহভঙ্গি
  • নিজের প্রশংসাকারীদেরকে তোষামোদ করা
  • নিজের সমালোচকদেরকে ঘৃণা করা
  • পূর্বাপর না ভেবে অন্যদেরকে দিয়ে নিজের কাজ করিয়ে নেয়া
  • আসলে যতোটা না, তার চেয়ে নিজেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভাবা
  • আত্মম্ভরিতা করা (সুক্ষ্ণভাবে কিন্তু প্রতিনিয়ত) এবং নিজের অর্জনকে ফুলিয়ে ফাপিয়ে উপস্থাপন করা
  • নিজেকে বহু বিষয়ের পণ্ডিত মনে করা
  • অন্যের দৃষ্টিকোণে বাস্তব পৃথিবী কেমন তা অনুধাবণে অসামর্থ্য
  • অনুতাপ এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশে অস্বীকৃতি/অনীহা

এদিকে স্বনামধন্য মার্কিন মনোচিকিৎসক এবং মনোবিশ্লেষক ডক্টর স্যান্ডি হচ্‌কিস-এর মতে একজন নার্সিসিস্ট-এর সাত ধরণের আচরণগত বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে, যেগুলোকে তিনি ‘ডেড্‌লি সিন্‌স’ বা ভয়াবহ পাপ নামে অভিহিত করেছেন। এগুলো হলোঃ
  • লজ্জাশূণ্যতা
  • অধিভৌতিক ভাবনা
  • ঔদ্ধত্য
  • হিংসা
  • বশ্যতা প্রাপ্তির উচ্চাভিলাস
  • ঠকবাজি
  • সীমাহীন অধিকারবোধ
এবার আসা যাক ‘হেল্‌দি নার্সিসিজম’ প্রসঙ্গে। হেল্‌দি নার্সিসিজম হলো নিজের সত্তার এক সুস্থিত সত্য বা সত্যোপলব্ধি, নিজের প্রতি নিজের এবং অন্য বস্তুর আনুগত্য অর্জন, সত্তার স্বাভাবিকতা এবং পরম অহংবোধের সুসংহত অবস্থা, এবং প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা ও উম্মত্ততার মধ্যে বিরাজমান ভারসাম্য। এটি ব্যক্তির মাঝে এক ধরণের অপরিবর্তনীয়, বাস্তবধর্মী স্বার্থ-সংশ্লিষ্টতা এবং পরিণত লক্ষ্য ও বিশ্বাস আর সেই সাথে বস্তু-কেন্দ্রিক সম্পর্ক গঠনের সক্ষমতা তৈরি করে। এটা অনেকটা অনিরাপত্তা ও অপর্যাপ্ততা প্রতিরোধী একধরণের আত্মবিশ্বাস। মানুষের স্বাভাবিক ব্যক্তিত্বের বিকাশে হেল্‌দি নার্সিসিজম অত্যাবশ্যকীয়। এতে আত্মপ্রেম অবশ্যই আছে তবে তা চারপাশের বাস্তবতাকে লীন করে এককেন্দ্রিকতা দেয়না। তাই এটি রোগের কোনো লক্ষণ নয়। এটি মানসিক সুস্বাস্থের সহায়ক।

এটা ঠিক যে, এই এনপিডি নিয়ে অনেকেই বিভিন্ন পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেছেন এবং মতামত দিয়েছেন। আর এভাবেই এর প্রকরণে যোগ হয়েছে নিত্য নতুন মাত্রা। যেমন এই শতাব্দীর একজন খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী সুইজারল্যান্ডের এ্যলিস মিলার, ২০১০-এর এপ্রিলে যার জীবনাবসান হয়েছে, নতুন এক অভিধা যুক্ত করেছেন যার নাম ‘নার্কাস্টিক এ্যবিউজ’ যা দ্বারা শিশুদের উপর বাবা-মা কর্তৃক একধরণের মানসিক নির্যাতনকে বুঝায়। এ্যলিসের ভাষায় এ ধরণের বাবা-মা হলেন ‘নার্সিসিস্টিক প্যারেন্ট্‌স, যারা অল্প বয়ষ্ক সন্তানের স্বতসস্ফূর্ত ইচ্ছের বিকাশকে রুদ্ধ করে নিজেদের সম্মান বৃদ্ধির প্রয়োজনে, কিংবা নিজেদের অপূর্ণ ইচ্ছেকে সন্তানের ভেতর বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে যেকোন চেষ্টায় পিছপা হননা। মূলত, বাবা-মা নিজেদের স্বপ্নের স্বাদ ঘোলে মেটানোর আশায় তারা সন্তানের উপর চাপিয়ে দেন তাদের রচিত স্বপ্ন নামক নিষ্ঠুরতা। এর ফলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরণের বাবা-মার সাথে শীঘ্রই সন্তানের দূরত্ব তৈরি হয়, আর তার চেয়েও ভয়ঙ্কর হলো সন্তানের ভেতর আত্ন-হনের প্রবণতা তৈরির সম্ভাবনাও কম নয়।

কর্মক্ষেত্রেও নার্সিসিজমের উপস্থিতি লক্ষনীয়, যা কর্মচারী এবং মালিক উভয়ের মাঝেই থাকতে পারে। একে বলা হয় কর্পোরেট নার্সিসিজম। যে মালিকের কাছে প্রফিট-ই একমাত্র লক্ষ্য, কিন্তু কর্মচারীর সুবিধা-অসুবিধা, স্বাস্থ্য এবং ঝুঁকির বিষয়টি কখনোই তার মাথায় আসেনা—তিনি আসলে নার্সিসিজমের শিকার। মালিক রোগীর এধরণের সংকীর্ণ মানসিকতা স্বল্পমেয়াদে বেশ সুবিধা বয়ে আনলেও আখেরে প্রতিষ্ঠানের জন্য বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে একজন নার্সিসিস্ট কর্মচারী কর্মক্ষেত্রে আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগে অদক্ষ হয়ে থাকেন। আর তার অতি সংবেদনশীলতা তাকে একসময় সন্ত্রস্ত করে তোলে। প্রায়শঃ তিনি সহকর্মীদের স্বাভাবিক ব্যবহার/আচরণকেও ভুল বুঝে কষ্ট পান এবং খুব সজেই অনেক বেশি আক্রান্ত বোধ করেন। ফলে কর্মক্ষেত্রে তার নিজের উৎপাদনশীলতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়, যা তার অবস্থান এবং আত্মসম্মানবোধকে আরও বেশি আহত করে।

‘কনভার্সেশনাল নার্সিসিজ্‌ম’ বলতে কথোপকথনের সময় আত্মমগ্নতার এক বিশেষ প্রকাশকে বুঝায়। এটা সাধারণত বন্ধু-বান্ধব, নিকট আত্নীয়-স্বজনদের মাঝে কথা বলার সময় এই আচরণ খুব সহজে পড়ে। একজন নার্সিসিস সাধারণত কারও সাফল্য কিংবা আনন্দের গল্প শুনতে আগ্রহী নন, বরং অন্যের কথা বলার সময় নিজেরটা চাপিয়ে দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন। অন্যের কাছ থেকে নিজের প্রশংসা শোনার জন্য ভীষণ ব্যাকুলতা থাকেন তিনি, এবং প্রশংসাকারী ব্যাতীত অন্য কারো গুণের কথা সাধারণত তিনি স্বীকার করেননা এবং তাদের সাথে তার সখ্যও হয়না। নিজের প্রাপ্তি আর সম্ভাবনার কথা প্রচার করতে এ ধরণের রোগী এতো মরিয়া হয়ে উঠেন আর বিষয় বর্ণনায় এতো অতিরঞ্জন করে থাকেন যে অন্যেরা বিরক্ত হতে বাধ্য হন। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, মোল্লা, আইনজীবিদের অনেকের মাঝে এই ধরণের প্রবণতা সহজেই চোখে পড়ে। সমালোচনাকারী আর শত্রু এদের কাছে সমার্থক। এরা সাধারণত আত্মসমালোচনা করতে অপারগ। আত্নম্ভরিতার চর্চায় স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কোনো কিছুকে বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে এরা সবার অলক্ষ্যে অনেকটা প্রতিবন্ধী হয়ে সমাজে বাস করতে থাকেন, বিনা চিকিৎসায়।

‘সেক্সুয়্যাল নার্সিসিজ্‌ম’ বলতে নিজের যৌনতা কিংবা প্রেমিক-সত্তার সক্ষমতাকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সব সময় নিজেকে কল্পনা করার প্রবণতাকে বুঝায়। কল্পনার এই নিমগ্নতা খুব দ্রুত দেহ-ভঙ্গি বা অন্যান্য বাহ্যিক আচরণে প্রকাশ পেতে থাকে। ছেলেদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এ ধরণের নার্সিসিস্টরা প্রেমকে যৌনতার প্রাপ্তি দিয়ে বিচার করতে পছন্দ করে। এর ফলে এরা সত্যিকারের আত্মিক সম্পর্কের চর্চার ব্যাপারে উদাসীন থাকে। নানাবিধ যৌন বিকার, নারীর উপর যৌন-নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতনের কারণ হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই সেক্সুয়াল নার্সিসিজ্‌ম দায়ী বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা।

এখন প্রশ্ন হলো এই রোগের কবল থেকে বাঁচার উপায় কী? এ ব্যাপারে প্রথমেই বলতে হয় যে, এটি নিজে নিজে সারানো বেশ মুশকিল। প্রথমত, এটা অনেকগুলো আচরণগত বৈশিষ্ট্যের সমম্বয়ে সৃষ্ট এক ধরণের জটিল সমস্যা, যা হুট করে বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে দূর করা সম্ভব নয়, যেখানে ধূমপানের মতো অভ্যাসকে ত্যাগ করাটাই অসম্ভব মনে হয় ধূমপায়ীর কাছে। দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত ব্যক্তির রোগ সম্পর্কিত সচেতনতার মানে এই নয় যে তিনি বুঝে গেছেন করণীয় কী, কারণ রোগের ধরণ অনুযায়ী প্রতিকারের উপায় সচেতনতা দিয়ে জানা সম্ভব নয়—এজন্য দরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পেশাদারী অভিজ্ঞতা। সেজন্য  একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট/থেরাপিস্ট-এর বিকল্প খুঁজতে যাওয়া নিতান্তই অনর্থক। তবে অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে, দুঃখকে বুঝবার এবং মনোযোগি শ্রোতা হওয়ার চেষ্টা করা, নিয়মিত আত্ম-সমালোচনা করা, বই পড়া, নতুন বন্ধু তৈরি করা এবং সামাজিক কাজকর্মে খোলা মন দিয়ে অন্যদের সাথে অংশগ্রহণ করা, ইত্যাদি এই রোগের নিরাময়ে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে। আসুন আমারা নার্সিসিজ্‌ম থেকে নিজেরা দূরে থাকি, অন্যদেরকেও দূরে রাখি।