Wednesday, December 17, 2014

লেজেন্ডারী ক্র্যাক প্লাটুন

শুরুর কথাঃ

“What is it that makes these boys have no fear”???

আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- ভারতীয় একটি মুভিতে এই সংলাপটি শুনে কেন জানি বিশাল একটা ধাক্কা খেয়েছিলাম। স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং এবং তাঁর সংগীসাথীরা যখন ফাঁসির মঞ্চে হেঁটে যাচ্ছেন-তাঁদের দৃপ্ত পদচারণা দেখে ব্রিটিশ জেলার মিস্টার ম্যাককিনলে বিড়বিড় করে নিজেকেই এ প্রশ্নটি করছিলেন । এটা দেখে আমার মাথাতেও একই প্রশ্নই খেলছিলঃ এই যে যাঁরা যুদ্ধে প্রাণ দেয়, এরাও তো আমাদের মত মানুষ। এরা আমাদের মতই ঝঞ্ঝাটহীন জীবনের স্বপ্ন দেখেছে কোন এক সময়ে, আনন্দের সাথে জীবন কাটিয়ে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে বৃদ্ধকালে মরতে চেয়েছে। কিন্তু যুগে যুগে প্রতিটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা অসামান্য একটা জিনিস দেখতে পাইঃ কিছু কিছু মানুষ সম্পূর্ণ সজ্ঞানে, সম্ভাব্য পরিণতির কথা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করার পরেও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মৃত্যুর হাতছানিতে সাড়া দেবার। এঁরা অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ভোগ করেছেন, স্কটিশ বীর উইলিয়াম ওয়ালেসের মত কারো কারো শরীর চার খন্ড করে দেশের চার প্রান্তে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে- ক্ষুদিরামের মত ১৬ বছর বয়েসে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হয়েছে কাউকে কাউকে। আর এর বিনিময়ে আমাদের মত মানুষেরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নিরাপদ জীবনের দ্রাক্ষারস ভোগ করে চলেছি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কোহিমা এলায়েড সিমেট্রিতে নাম না জানা সৈনিকদের এপিটাফে লেখা দুটি বিখ্যাত লাইন এখানে খুব প্রাসংগিকঃ

When you go home, tell them of us and say,
For your tomorrows these gave their today.

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের সবচাইতে গৌরবদীপ্ত ঘটনা- বাংলাদেশের নাগরিকমাত্রই এটি নিয়ে দ্বিমত করার কেউ থাকার কথা না। কিন্তু দুঃখ, ক্ষোভ আর লজ্জার সাথে দেখি, আমাদের দেশে এমন একটা প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা কিনা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শুধুমাত্র উদাসীনই নয়, এদের কেউ কেউ পাকিস্তানি বরাহশাবকদের প্রেতাত্মাকে লালন পর্যন্ত করে। এই রাগ থেকেই সিদ্ধান্ত নিই মুক্তিযোদ্ধাদের কথা লিখব-অন্ততঃ নিজের জন্যে হলেও। ভুলভ্রান্তি, অযোগ্যতা , ভাষার ত্রুটি , সামরিক জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা- এগুলো মাথায় রেখেই লিখবো। অনেকটা রবিঠাকুরের কবিতার মাটির প্রদীপের মতঃই

কে লহিবে মোর কার্য কহে সন্ধ্যা রবি
সমগ্র জগৎ রহে নিরূত্তর ছবি
মাটির প্রদীপ ছিল , সে কহিল স্বামী
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি

“জনযুদ্ধের গণযোদ্ধা” বইটির লেখক মেজর কামরুল হাসান ভুঁইয়া স্যারের সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে ইতোপূর্বে লেখা একটি ব্লগে বলেছিলাম ক্র্যাক প্লাটুন গেরিলা ফতে আলী চৌধুরীকে নিয়ে একটি লেখা দেবার কথা। সেটা ছিল সেই ২০০৯ সালে- এই পাঁচ বছরে নানা কারণে লেখাটি দাঁড় করানো হয়ে ওঠেনি। ২০১৪ সালে এসে হঠাৎ নিজেকে আবিষ্কার করলাম জাপানে, এবং সেই সাথে পরিচয় হল এমন একজনের সাথে যে কিনা এই দায়িত্বটি আমার চাইতে অনেক ভালোভাবে পালন করতে পারবে। “রাআদ রহমান” বললে আপনারা হয়তো চিনবেন না, কিন্তু “ডন মাইকেল করলিয়নে” ছদ্মনামে ফেসবুক গ্রুপ ক্রিকেটখোরের অসাধারণ সব পোস্টের লেখককে আপনারা অনেকেই চেনেন। আমরা দুজন সিদ্ধান্ত নিলাম বিজয় দিবসে আমাদের সুপারহিরোদের অন্ততঃ একজনকে নিয়ে যৌথভাবে কিছু লেখার, যার ফলশ্রুতি হচ্ছে এই ব্লগ। এ লেখাটির ৯৫% কৃতিত্ব রাআদের, প্রথম থেকে সপ্তম পর্ব আমাকে করা ওর ইমেইল থেকে সরাসরি তুলে দিচ্ছিঃ

প্রথম পর্বঃ

বনেদী ঘরের ছেলে ছিল ফতেহ আলী চৌধুরী, বাবা ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান আমলের ডিসট্রিক্ট জাজ। একটা আলাদা লেভেলে চলাফেরা ছিল ওর, অভিজাত বংশের কুল ডুড বলতে যা বোঝায়। রংচঙে হালফ্যাশনের জামাকাপড়, চোখে সানগ্লাস, নতুন মডেলের গাড়িতে করে ভার্সিটিতে যাওয়া-ইত্যাদি ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন। একটা মেয়েকে খুব পছন্দ করতো, নাম গুড়িয়া। অবাঙ্গালী। থাকতো হাটখোলাতেই, ফতেহদের বাড়ির তিনচার বাড়ি পর। প্রতিদিন একবার করে গুড়িয়াকে না দেখলে দিনটাই মাটি হয়ে যেত ওর।পড়াশোনাতেও বেশ চৌকষ ছিল ফতেহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার সময়ের অন্যতম হাইপ্রোফাইল সাবজেক্ট ইংলিশে পড়ত , ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ছিল ও। খেলাধুলাতেও ছিল সমান দক্ষ। বাস্কেটবলটা সবচেয়ে ভালো খেলতো, প্রিয় বন্ধু কাজী কামালউদ্দিনের সাথে পরিচয় বাস্কেটবল খেলতে গিয়েই। কাজী কামালউদ্দিন ততদিনে তুমুল শোরগোল ফেলে দিয়েছে অসাধারন পারফর্ম করে, পাকিস্তান ন্যাশনাল বাস্কেটবল টিমে জায়গা পাবার দাবীটা বেশ জোরালো করে তুলেছে। তবে ফতেহ ছিল সব্যসাচী। ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে কেবল বাস্কেটবলই খেলতো না, ক্রিকেটটাও চালিয়ে যেত সমানতালে। ব্রাদার্সের রানা ভাইকে যেদিন এসে বলল ও ক্রিকেটটাও ভালো খেলে, তখন রানা ভাই ভুরু কুঁচকে গম্ভীর গলায় জানতে চাইলেন, কোনটা ভালো পারো হে? ব্যাটিং, বোলিং না ফিল্ডিং? সদারসিক ফতেহ রহস্য করে জবাব দিল, ভাই, কোনটাই তো ভালো পারি না, আবার সবটাই পারি। আমি হইলাম অলরাউন্ডার। শুনে তো রানা ভাই গেল ক্ষেপে, মানে কী? টেস্ট নেওয়া হল ফতেহর, একটা ম্যাচে নামিয়েও দেওয়া হল। এইবার রানা ভাইয়ের অবাক হওয়ার পালা, সুন্দর অফ স্পিন করে ফতে, ব্যাটিংয়ে ধুমধাম মেরে কিছু রান করে আসছে, ফিল্ডিংটাও চমৎকার,নিজেই চেয়ে নিল কিপিং করবে, দেখা গেল উইকেটকিপিংও পারে। তব্দা খেয়ে রানা ভাই বলে, কাহিনী কিরে? কাঁচুমাচু স্বরে ফতেহ জবাব দিল, আমিও বুঝতেছি না। মনে হইতেছে কিপিংটাই ভালো পারি, বাকিগুলা অপশোনাল…

এই ছিল ফতেহ, সমাজ-সংসার-দেশ-রাজনীতি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এক মানুষ, ঘুরছে, ফিরছে, আড্ডা দিচ্ছে, মজা করছে আর তখনকার ফ্যাশান থিউরি কপচাচ্ছে, বিপ্লবের থিউরি। সবসময় পকেটে ঘুছে মাউ সে তুং এর দ্যা রেডবুক- কমিউনিজমের হটকেক। ভার্সিটির ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুদের বিপ্লবের মতবাদ শুনে শুনে মার্ক্সবাদী থিউরি বুঝতে নাছোড়বান্দার মত লেগেছে তখন ফতেহ, যেখানে যা পাচ্ছে সব পড়ে ফেলছে এক নিমিষে। রেভলিউশনের মায়াজালে বুঁদ হয়ে থাকা ফতেহ তখনো কল্পনাও করতে পারেনি কি ভয়ংকর এক বাস্তবের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। ২২ বছর বয়সী ফতেহর চারপাশে ঘিরে থাকা বিচিত্র সেই জগতের ঠিক বাইরেই তখন চলছিল এক সত্যিকারের বিপ্লব, যে বিপ্লবের ফাউন্ডেশন ছিল ২৪ বছরের দীর্ঘ নিষ্পেষণ, অকথ্য নির্যাতন আর শোষণ, বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মাঝের সরলরেখাটা খুব ক্ষীণ ছিল যে বিপ্লবে, যে বিপ্লবে থিউরির কোন স্থান ছিল না, সবই ছিল নির্মম প্রাকটিক্যাল, যে বিপ্লবটা হয়েছিল একাত্তরে, সময়টা তখন মার্চ, একাত্তরের অগ্নিগর্ভ মার্চ…

দ্বিতীয় পর্বঃ

মার্চের ২৫ তারিখ সন্ধ্যায় কে যেন হঠাৎ এসে বলল, আজকে রাতে ক্র্যাক ডাউন হবে। ফতেহ তেমন গুরুত্ব দিল না। এ আর এমন কি ? ডেইলিই তো হচ্ছে। আর্মি নামছে রাস্তায়, বিক্ষোভ ঠেকাতে, ঠা ঠা করে গুলি করছে, কিছু মানুষ হুট করে মৃত লাশে পরিনত হচ্ছে, এ তো প্রতিদিনের ঘটনা। সত্যি বলতে কি, রাজনীতি কিংবা জনগনের দাবী সম্পর্কে কখনই তেমন আগ্রহ ছিল না ফতেহর, তাই ২৫শে মার্চ সন্ধ্যায় আসন্ন ক্র্যাক ডাউনের খবর পেয়েও তার তেমন ভাবান্তর ঘটল না। সে বরং বেরিয়ে গেল হকিস্টিক নিয়ে, তাদের পাড়াটায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য আজিম ভাই( বিখ্যাত চিত্রনায়ক আজিম) এগুলো কিনে দিয়েছেন তাদের। সে রাতে অবশ্য খুব বিচিত্র এক কাজ করল ফতেহ আর তার পাড়ার ছেলেগুলো, তাদের হাটখোলা বড় রাস্তাটায় গিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে এল। পাড়ায় পাড়ায় রাস্তায় রাস্তায় সবাই বড় বড় গাছ ফেলে ব্যারিকেড দিচ্ছে, তাদের পাড়া কেন পিছিয়ে থাকবে? কোন আদর্শগত বা স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়, স্রেফ পাড়ার ইগো বজায় রাখতেই তারা রাস্তা-ঘাট আটকে দিল। কি উত্তেজনা… শেষ পর্যন্ত ঘুমাতে যেতে বেশ দেরী হয়ে গেল ওদের, এবং ঘুমোবার কিছুক্ষনের মধ্যে হঠাৎ মর্টার শেলিং আর মেশিনগানের ঠা ঠা শব্দে লাফ দিয়ে উঠে বসলো সবাই। বাইরের আকাশ তখন অত্যাধুনিক ট্রেসার বুলেটের ফুলকি আর ফ্লেয়ারের আলোয় আলোকিত, বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে আর্তনাদ আর আর্তচিৎকারে। পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম এক আঁধার রাতের শুরু ছিল সেটা, যে অমানিশার গালভরা নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট। পরদিন বাইরে বেরিয়েছে ফতেহ, হঠাৎ ওর চোখ পড়ল ভিসতিওয়ালার উপর, (ভিসতিওয়ালা –যারা বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহ করতেন) ওদের বাড়ির সামনে মানুষটা মরে পড়ে আছে, গুলিতে গুলিতে বুকটা ঝাঁঝরা। সকালে বোধহয় পানি দিতে বেরিয়েছিল, পাকিস্তানী সেনারা কুকুরের মত গুলি করে মেরেছে ওকে, চেহারায় বিস্ময় আর অবিশ্বাসের ছাপটা তখনো স্পষ্ট, যেন এভাবে বিনা কারনে মরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। স্থির হয়ে যায় ফতেহ, হঠাৎ মনে পড়ে যায় একটা মুভির কথা, দ্যা ট্রেন, ২য় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত। সালটা ১৯৪৪। ফ্রান্সের লুভ্যর মিউজিয়ামের বিশ্বখ্যাত সব চিত্রকর্ম জার্মান সেনারা লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। ঠিক হল, ওদের ট্রেনে হামলা চালানো হবে। ফ্রেঞ্চ গেরিলাদের একটা বাহিনী ওঁত পেতে থাকলো, ট্রেনের যাত্রাপথের সব ষ্টেশনের নাম চেঞ্জ করে ফেলা হল, ট্রেনটাকে নিয়ে যাওয়া হতে লাগলো রং ডিরেকশনে। রেঞ্জের মধ্যে আসতেই হামলা করল ফেঞ্চ গেরিলারা, প্রচণ্ড যুদ্ধ শেষে কেবল জার্মান সেনাদের কমান্ডার কর্নেল ভ্যান ওয়াইল্ডহাম আর গেরিলা ল্যাভিশে বেঁচে রইল। তাচ্ছিল্যের স্বরে জার্মান কর্নেল বলতে লাগলো, ইউ আর নাথিং ল্যাভিশে, নাথিং বাট আ লিম্প অফ ফ্লেশ। বিউটি বিলংস টু দোজ হু ক্যান এপ্রিশিয়েট ইট, ইউ পিপল নট ইভেন ডিজার্ভ ইট। হঠাৎ ল্যাভিশের চোখ পড়ল কিছু ফ্রেঞ্চের উপর, তার মধ্যে একটা ফুটফুটে মেয়ে, ১৫-১৬ বছর বয়সী, মরে পড়ে আছে। চেহারায় তখনো অসহায় আকুতি। মাথায় আগুন ধরে গেল ল্যাভিশের, পলকের মধ্যে মেশিনগান তুলে গুলি করলো কর্নেলকে। পিকাসো কিংবা ভিঞ্চির অসামান্য চিত্রকর্ম না, তাকে ধাক্কা দিয়েছিল মিষ্টি কিশোরীর নিষ্পাপ মুখটা। ভিস্তিওয়ালার নিষ্প্রাণ অসহায় চেহারাটা দেখতে দেখতে আচমকা সেই ১৫-১৬ বছর বয়সী ফ্রেঞ্চ মেয়েটার মিষ্টি চেহারাটা ভেসে উঠলো ফতেহ’র সামনে, কোন পার্থক্য খুঁজে পেল না সে ভিসতিওয়ালার সাথে। চোয়ালটা হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল ফতেহর, একটা অস্ত্রের বড্ড দরকার…

তৃতীয় পর্বঃ

শাহাদাৎ চৌধুরী ছিল ফতেহর বড় ভাই, পাঁচ বছরের বড়। অসাধারন ব্যক্তিত্ব, চমৎকার চেহারার এই মানুষটি খুব ভালো প্ল্যান করতে পারতেন। একাত্তরের ২৬শে মার্চ সকালে কেবল প্রতিশোধের প্ল্যান ঘুরছিল তার মাথায়। কিছুক্ষন পর হাজির হল দুধওয়ালা, তারা বেঁচে আছে দেখে খুব অবাক হল। আসতে আসতে রাস্তায় যে বিচিত্র মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ দেখছে সে, সেটা বর্ণনা করতে শুরু করল। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল, কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, আপনারা আমার বাড়ি চলেন, ত্রিমোহনী এখনো নিরাপদ। কেউ একজন বললো জিঞ্জিরার দিকে যেতে, কিন্তু ফতেহর বাবা জাজ সাহেবের সিক্সথ সেন্স বললো, জিঞ্জিরায় গেলে মহাবিপদ হতে পারে( তার এই আশংকা বড় বিস্ময়ভাবে সত্য হয়ে যায়, জিঞ্জিরায় প্রানভয়ে আশ্রয় নেওয়া মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি সেনারা, যেটা জিঞ্জিরা ম্যাসাকার নামে পরিচিত।কবি নির্মলেন্দু গুণ এটার কথা তাঁর “আত্মকথা ১৯৭১” এ বলেছেন) ।সুতরাং দুধওয়ালার সাথে চলে যাওয়াটাই বেটার অপশন। তিন বোন, মা আর বড় ভাইকে নিয়ে ত্রিমোহনী চলে এল ফতেহ। স্থির হয়ে বসতে না বসতেই শাচৌ গায়েব, একটু পর তাকে দেখা গেল ফিরে আসতে। ফতেহকে ডাকলেন, এদিক আয়। গোপন শলাপরামর্শ করছেন এমন ভঙ্গিতে ফতেহকে বললেন, কিছু পুলিশ আছে এইখানে, রাজারবাগ থেকে পালায়ে আসছে। গতকাল রাতে তো পাকিস্তানীগুলার সাথে বিশাল ফাইট দিছে পুলিশগুলা, শেষে যখন ভারী এমজি(মেশিনগান) দিয়া ফায়ার শুরু করছে, তখন আর পারে নাই। বেশিরভাগই মারা গেছে, কয়েকজন পলায়ে আসছে এইখানে, এক বাড়িতে আশ্রয় নিছে। চল দেইখা আসি।

পুলিশদের এই বীরত্বগাঁথা শুনে ফতেহ যেন পাল্টে গেল। পুলিশদের সাথে জনগণের সম্পর্ক এখনের মত তখনও ভালো ছিলো না- ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি তখনো টাটকা। “পুলিশ তুমি যতই মারো, বেতন তোমার একশ বারো”- যে পুলিশকে নিয়ে ছাত্ররা টিটকারী করত সরকারের পক্ষে কাজ করার কারণে- সেই হাবাগোবা পুলিশ যদি এভাবে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত কয়েকটা খেলনা অস্ত্র(পাকিস্তানি আর্মির অস্ত্রের তুলনায় বাঙ্গালী পুলিশের অস্ত্র খেলনাই ছিল)নিয়ে ফাইট করতে পারে মেশিনগান আর ট্যাংকের বিরূদ্ধে, তাহলে আমি কেন বসে আছি?! যুদ্ধে করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ফতেহ পুলিশগুলোকে দেখতে গেল ভাইয়ের সাথে। কিন্তু তাদের হতাশ হতে হল। দুধওয়ালা বুঝিয়ে বলল, এখন যাওয়াটা ঠিক হবে না। সারারাত যুদ্ধ করে ভয়ংকর ক্লান্ত মানুষগুলা, বিশ্রাম নিচ্ছে আপাতত, পরে আসেন। মনঃক্ষুণ্ণ এবং কিঞ্চিৎ অপমানিত হয়ে ফিরে আসবার সময় হঠাৎ নদীর পাড়ে নৌকা থেকে কেউ একজন ডাকলো ওদের।কাছে যেয়ে দেখল , নানা বয়সের অনেকগুলা মানুষ, বাক্স-পেঁটরা নিয়ে পালাচ্ছে ওরা। যে ডেকেছিল, সে বাষ্পারুদ্ধ গলায় বলল, ভাই দেখেন তো, রেডিওতে কোন মেজর জিয়া না কে যেন স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়া কি বলল… আপনারা কিছু শুনছেন নাকি? আশে পাশে আরও কয়েকজন দাঁড়াইয়া ছিল, হঠাৎ একজন বলল, হ আমি শুনছি। মেজর জিয়া নামে একজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিছে, একটু আগেই শুনছি। ততক্ষনে আরেকজন এসে বলল, খালেদ মোশাররফের ফোরথ বেঙ্গল রেজিমেন্ট , সফিউল্লাহর সেকেন্ড বেঙ্গল, ফার্স্ট বেঙ্গলে ক্যাপ্টেন হাফিজ সবাই বিদ্রোহ করছে, যুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে।

কথাটা শেষ হবার আগেই ফতেহর হাত ধরে শাচৌ বলল, চল, খবরটা পুলিশগোরে দিয়া আসি। এইবার নক করতেই দুধওয়ালা ভিতর থেকে একটু বিরক্তস্বরে বলল, আবার কি ভাই? শাচৌ বলল, জরুরি খবর দিতে হবে, গেটটা খুলেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভিতরে নিয়ে গেল দুধওয়ালা, মানুষ দেখেই চমকে উঠলেন এক পুলিশ সার্জেন্ট, শাচৌর পরিচয় দেওয়ার পর ধমক দিয়ে বললেন, কি চাই এইখানে? সমান তেজে জবাব দিল শাহাদাৎ চৌধুরী, কিচ্ছু না, খালি একটা কথা জানাইতে আসছি। ফোরথ বেঙ্গলের কর্নেল খিজির হায়াত খানকে বন্দী করা হইছে, মেজর খালেদ মোশাররফ বিদ্রোহ করছে সেইখানে, সেকেন্ড বেঙ্গলে শফীউল্লাহ, ফার্স্ট বেঙ্গলে ক্যাপ্টেন হাফিজ বিদ্রোহ করছে, একটু আগে মেজর জিয়া শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করছে, ওয়ার ইজ অন—চিৎকার করে কথাগুলা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল শাচৌ। অবাক চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো ফতেহ, তার জীবনে এতো পড়াশোনা করা মানুষ সে আর দেখে নাই, শান্ত চেহারার সৌম্য দর্শন ঠাণ্ডা প্রকৃতির এই মানুষটার ভিতরে যে এমন লাভাস্রোত লুকিয়ে ছিল, সেটা কে জানতো?

চতুর্থ পর্বঃ

কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির আশফাকুস সামাদ আশফি, বড় ভাইকে তখন হাত পা নেড়ে নেড়ে তারাবো পর্যন্ত চলে আসা দুই ট্রাক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যের খবর দিচ্ছে ফতেহ। শান্ত শিষ্ট ভদ্র ছেলে একটা ছেলে আশফি, কিন্তু তখন সেই মুহূর্তে ফতেহ ওকে চিনতে পারে না। ‘পাঞ্জাবীগুলা এইভাবে মানুষ মারলো? বিনা কারনে,বিনা অপরাধে এতগুলা মানুষ এইভাবে মারা গেল? নো, আই কান্ট টেক ইট এনিমোর, লেট’স ফাইট ব্যাক”। যুদ্ধে যেতে উন্মুখ হয়ে আছে ফতেহও, কিন্তু কিভাবে কোথায় যাবে, পরিচিত কেউ যাচ্ছে কিনা, জিজ্ঞাসা করছিল সে। চিবিয়ে চিবিয়ে আশফি বললো, বদি, বাদল, বকুল, বাচ্চু সবাই বের হয়ে যাইতেছে যুদ্ধে, আর তুই অখনো বইসা বইসা মাস্টারবেট করতাছোস ? আরে শালা, বাইর না হইলে ক্যামনে বুঝবি কই যাইতে হইব? আগে বাইর হ”। আশফির চোখ দিয়ে রীতিমত আগুন ঝরছে।

কথাটার ভিতর বোধহয় বারুদ মেশানো ছিল, তাই কয়েকদিন পরেই ফতেহ, মায়া(মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, বীর বিক্রম) গাজি(গাজি গোলাম দস্তগীর বীর বিক্রম) , সিরাজ সহ ছয়সাতজন রওনা দেয়। তাদের সাথে আরও একজনের যোগ দেওয়ার কথা। তার নাম কাজী কামাল(কাজি কামালউদ্দিন) , কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও যখন তার দেখা পাওয়া গেল না, তখন ওকে ফেলেই চলে গেল সবাই। ওরা যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে কাজী কামাল। শাহাদাৎ চৌধুরী আফসোস করে , “আইলা যখন, আরেকটু আগে আইতে পারলা না? ওরা তো ওয়েট করতে করতে চইলা গেল। তাড়াতাড়ি সদরঘাট যাও, মতলবের লঞ্চে খুজবা, দেখো পাইলেও পাইতে পারো।টর্নেডোর বেগে বের হয়ে যায় কামাল, খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত পেয়ে যায় ওদের। ফতেহ বলে, আসছস, ঠিক আছে। কিন্তু প্রতিজনের টাকা লাগবো ১৭০ কইরা, আনছস ওইটা? কামাল থমকে যায়। যুদ্ধে যেতে যে টাকা লাগতে পারে, সেটা তো তার মাথায় আসেনি। দাঁড়া , আসতেছি, বলেই সে নেমে যায়, হারিয়ে যায় জনারণ্যে।

হুট করে টেনশনে পড়ে ফতে, কই গেল পোলাটা? এখন যদি লঞ্চ ছাইড়া দেয়? মেজাজ খারাপ হতে শুরু হয়েছে কেবল, তখনই হাসিমুখে উদয় হল কামাল। হাতে টাকা। ফতে অবাক, টাকা পাইলি কই? কামাল বাম হাত তুলে দেখায়, ঘড়ির জায়গাটা খালি। এইবার অবাক হয় ফতেহ, এইটা না তোর প্রিয় ঘড়ি ছিল? “’ তাতে কি হইছে?” নিজেকে ডিফেন্ড দেয় কামাল। “টাকা দরকার, বেইচা দিলাম। দেশ স্বাধীন হইলে আবার কেনা যাইব”। অবাক ফতেহ তাকিয়ে থাকে, মুখে কথা যোগায় না।

২৭ তারিখ সকালে কারফিউ ওঠার পরেই বের হয়ে গিয়েছিল বদিউল আলম, শহিদুল্লাহ খান বাদল, আশফাকুস সামাদ আশফি আর মাসুদ ওমর।নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু প্রথমে পায়ে হেটে যায় কুমিল্লা, সেখানে খবর পায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে মিরেরসরাই, পায়ে হেঁটেই চলে যায় চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ে। অবশেষে ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্পের খবর পেয়ে আগরতলা হয়ে চলে যায় মতিনগর। তাদের সাথে যোগ দেয় বকুল (মুস্তফা কামাল বকুল) বন্ধুমহলে যাকে বডিবিল্ডার হিসেবে সবাই এক নামে চিনত।ফতেহকে সে হাসতে হাসতে বলেছিল, খায়াদায়া তো বিশাল শরীর বানাইলাম, যাই কয়েকটা পাকি মাইরা আসি দোস্ত। আরও হাজির হয় মানিক, মাহবুব, আসাদ( রাইসুল ইসলাম আসাদ, অভিনেতা) । এপ্রিলের শুরুর দিকে চলে আসে জিয়া( জিয়াউদ্দিন আলী আহমেদ, বীর বিক্রম) , হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, দুই জমজ ভাই মুনির আর মিজান, শ্যামল, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর ছেলে ভাষণ এবং মেজর কাইয়ুম। তারপর শেষমেষ হাজির হয় ফতেহরা, মায়াকে মতলব থেকে তুলে নিয়ে সোনামুড়া বন্দর হয়ে আগরতলা হাজির হয় ফতেহ, কাজী কামাল, গাজি, সিরাজ, জুয়েল( আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল বীর বিক্রম) । আগরতলা থেকে ভাগ্যচক্রে মেজর ডাঃ আখতার বীর প্রতীককে পেয়ে যায় ওরা, উনার সাহায্যে চলে আসে মতিনগর। জুনের প্রথম সপ্তাহে ক্যাম্প আরও ১০ মাইল দূরে মেলাঘরে সরিয়ে নেবার আগ পর্যন্ত মতিনগরেই ছিল গেরিলাদের ট্রেনিং ক্যাম্প।

ফতেহ’র আজো স্পষ্ট মনে পড়ে খালেদ মোশাররফকে, বর্ডারের ঘন জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের নিচে অ্যাটেনশন হয়ে দাড়িয়ে ছিল ওরা, হঠাৎ নেমে এলেন তিনি, পাথুরে শান্ত চেহারা, সৌম্য দৃষ্টি, তবে একটু ভালো করে তাকালেই বুঝতে পারা যায় চোখটা আসলে তপ্ত ভাটার মতো জ্বলছে । নেমে কিছু কথা বললেন তিনি, কথাগুলোর ভেতরে বোধহয় বারুদ লুকানো ছিল, এক অনির্বচনীয় অনুভূতি হল সবার। শেষে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন জনৈক মেজর হায়দারের সাথে, বা হাত ভাঙ্গা, স্লিঙ্গে ঝুলছে। বিকালের মরে আসা নরম আলোয় শক্ত চেহারার ভাবলেশহীন এ মেজরকে ফতেহর হঠাৎ কোন গ্রীক দেবতার স্কাল্পচার বলে মনে হল। পাকিস্তান আর্মির স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের ডাকসাইটে কমান্ডো ছিলেন এই মেজর, তিনিই ঢাকা এরিয়ার কমান্ডার হবেন, তার নেতৃত্বেই বিভিন্ন হাবিলদার, সুবেদার মেজররা গেরিলাদের ট্রেনিং দেবেন।ফতেহ আলী চৌধুরীর এক ভিন্ন জীবন শুরু হল। মেজর হায়দার নামের এই মানুষটা যে কতটা অসামান্য একজন ইন্সট্রাকটর এবং লিডার ছিলেন, সেটা আরবান গেরিলাদের এই দলটা খুব দ্রুতই বুঝে গেল।

একেবারে বিজন পাহাড়ে জঙ্গল কাটা, তাবু তৈরি, খাওয়া দাওয়ার কষ্টকর ব্যবস্থা থেকে শুরু করে হাড়ভাঙ্গা ট্রেনিং– সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন মেজর হায়দার। ব্যক্তিত্বের পারফেকশনে কড়া শিক্ষককে ট্রেনিংয়ের সময় বাঘের মতো ভয় পেত সবাই, কিন্তু যখন কেউ হঠাৎ করেই কিছু একটা শিখে ফেলতো, করে দেখাত নিখুঁত ভাবে, তখন তৃপ্তির একটা হাসি ফুটে উঠত তাঁর মুখে, পিঠ চাপড়ে বলতেন, ওয়েল ডান, বয়,ওয়েল ডান। ব্যস, সব রাগ-অভিমান ভ্যানিশ।ফতেহ আলী চৌধুরী মানুষ হিসেবে ছিল সদারসিক, কারোর কোন কথা মাটিতে পড়তে দেবে না, জবাব রেডিই আছে। এমন একটা কথা বলবে যাতে মানুষটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েও হেসে ফেলতে বাধ্য। মেজর হায়দারের খুব প্রিয় সোলজার ছিল ফতেহ, যেকোনো গুমোট পরিস্থিতি খুব সহজে হালকা করে ফেলতে পারত ছেলেটা। একবার এক্সপ্লোসিভ ট্রেনিং চলার সময় একটা গাছে এক্সপ্লোসিভ লাগাতে বললেন হায়দার। লাগিয়েই সবাইকে সরে যেতে বললেন, সবাই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সরে গেল। সবাই, কেবল ফতেহ আলী ছাড়া। বিকট বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে গেল, তার মধ্যেই হায়দার খেপে গিয়ে ফতেহকে জিজ্ঞেস করলেন, সরে যেতে বললাম না? খাম্বার মতো দাঁড়ায়া ছিলা কেন? চটপটে ফতেহর উত্তর, আপনি তো স্যার যান নাই, আমি কেবল আপনারেই ফলো করছি মাত্র। মরতাম না এদ্দুর সিউর ছিলাম। জবাব শুনে ফতেহকে এই মারেন তো সেই মারেন হায়দার, ফাজিল পোলা, মাইর না খাইলে সিধা হইবা না…

পঞ্চম পর্বঃ

জুনের প্রথম সপ্তাহে মুভমেন্ট অর্ডার আসলো, মতিনগর থেকে আরও ১০ মাইল ভিতরে ঘন জঙ্গল মেলাঘরে ক্যাম্প তৈরি করা হল। প্রথম পর্বের যারা এসেছিল, তাদের ট্রেনিং শেষ। এবার ২য় পর্বে নতুন ছেলেরা আসবে, তাদের ট্রেনিং হবে। প্রথম পর্বের মাঝামাঝি এসে যোগ দিয়েছিল রুমি, সেকান্দার হায়াত, হাফিজ প্রমুখ। বারুদের টুকরো একেকটা, কর্নেল হায়দারের মতো অসাধারন ট্রেনারের ছোঁয়া পেয়ে জ্বলে উঠেছিল দাবানলের মতো, পরবর্তীতে কাঁপিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানীদের অন্তরাত্মা। এদের মধ্যে কাজী কামালকে দেখে অবাক হয়েছিল সবাই, প্রভিন্সিয়াল বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন কামাল ডাক পেয়েছিল পাকিস্তান জাতীয় বাস্কেটবল টিমের প্রাথমিক দলেও। যা প্রতিভা ছিল, তাতে যে বাস্কেটবলে এক অসাধারন ক্যারিয়ার অপেক্ষা করছিল ওর জন্য, তাতে কোন সন্দেহ নাই। ফেলে চলে আসলো সব, খ্যাতি, অর্থ, ক্যারিয়ার কোনকিছুর পরোয়া না করে।

বিদায়ের বাঁশি বাজলো। দুটো মাস একসাথে ট্রেনিং নিতে এবং করাতে যেয়ে এমন এক বাধনে বাঁধা পড়েছিলেন মেজর হায়দার আর গেরিলারা যে সেটা কাটাতে কষ্ট হল খুব। খালেদ মোশাররফের অমিত ব্যক্তিত্বের কারনে তাঁকে সবাই দূর থেকে সম্মান করতো, ভালোবাসতো, আইডল হিসেবে স্যালুট করতো। কিন্তু মেজর হায়দার ছিলেন তাদের খুব আপনজন, খালেদের মতো একই ছাঁচে রাশভারী ব্যক্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও ট্রেনিংয়ের মাঝে কখন যেন ছেলেদের সাথে মিশে গিয়েছিলেন মানুষটা। তাই যে রাতে ওদের ঢাকায় অপারেশনে চলে যাবার কথা, সেরাতে এক অদ্ভুত বিষাদ গ্রাস করেছিল মেজর হায়দারকে, শক্ত বহিরাবরণ ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলো বিষণ্ণতার ধূসর চেহারা।
মুক্তিবাহিনীর মাত্র এই ১৭ জন গেরিলাই কাঁপিয়ে দেয় পুরো ঢাকা শহর।এশিয়ার সেরা যুদ্ধবাজের দাবীদার এবং হাজার হাজার প্রশিক্ষিত আধুনিক সোলজার নিয়ে গড়া হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী হঠাৎ উড়ে আসা গ্রেনেড আর আঁতকা অ্যামবুশে পড়বার ভয়ে ইঁদুরের বাচ্চায় পরিনত হয়। বিশেষ করে পুরো জুলাই জুড়ে চালানো বেশ কয়েকটা ভয়ংকর অপারেশনের পর এক পর্যায়ে ভয়ের চোটে সন্ধ্যার পর পাকিস্তানীদের নিয়মিত টহলে বের হওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। সবসময় এক ভয়ংকর আতংক পিছু তাড়া করে বেড়াত তাদের, একযোগে ঢাকার সবকটা অঞ্চলে অপারেশন চালানোয় প্রচণ্ড আতংকিত হয়ে ওরা ভাবতো, হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা বোধহয় ওদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। ভয়ে আরও আতংকিত হত ওরা। এই অসামান্য বীরত্বগাঁথা চলতেই থাকে, এক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এদের থামাতে দ্বারস্থ হয় তাদের এ দেশীয় পোষা বরাহকূলের, যাদের নাম আলবদর।

ষষ্ঠ পর্বঃ

একাত্তরের ২৯শে আগস্ট। আলবদরের কর্মীদের তথ্য মতো সকাল ১১ টায় বদিউল আলম ধরা পড়ে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল জালালউদ্দিনের বাসা থেকে, শুরু হয় এক যন্ত্রণাময় করুণ অধ্যায়ের। বিকাল চারটার সময় ধরা পড়ে আব্দুস সামাদ, অকল্পনীয় টর্চারের মুখে সে আলতাফ মাহমুদের ঠিকানা বলে দিতে বাধ্য হয়। বদি আর সামাদের ধরা পড়বার খবর পেয়ে ইশ্তিয়াক আজিজ উলফাত ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরিয়ে যায়, বেবিট্যাক্সিতে চড়ে চলে যায় ৩০ নম্বর হাটখোলা, ফতেহ আলী চৌধুরী আর শাহাদাৎ চৌধুরীর বাসায়। গেটের সামনেই পেয়ে যায় ফতেহকে, জানায় রেইড আসন্ন। শাচৌ তখন মেলাঘরে, কিন্তু রিস্ক তারপরও ছিল। বাবা ডিসট্রিক্ট জাজ আবদুল হক চৌধুরী, মা, তিনটা বোন মারিয়াম, ঝিমলি আর ডানা- প্রত্যেকেই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্র গোলাবারুদ লুকায়ে রাখা, সেই গুলা পরিচর্যা করা, যত্ন নেওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া, আপনজনের মতো দেখভাল– সব কিছুই করতো এরা অদ্ভুত নিষ্ঠার সাথে… তাই খবরটা পাওয়া মাত্র তিন বোনকে উলফাতের বেবিট্যাক্সি করতেই আরেক বোনের বাসায় নিয়ে যায় ফতেহ। তারপর সেইখান থেকে চলে যায় এলিফ্যান্ট রোড, জাহানারা ইমামের বাসা খুঁজতে। কিন্তু বহু খুজেও প্রিয় সহযোদ্ধা রুমির বাসাটা খুঁজে পায় না ও। ভয়ংকর দুর্ভাবনায় বিফল মনোরথে ফিরে যায় ফতে, আর সেইদিনই রাত ২ টার ধানমণ্ডির কনিকা থেকে জামি, রুমি, শরীফ ইমাম, মাসুম, হাফিজ এই পাঁচজনকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী সেনারা। একই সময়ে আরও রেইড হয় শাচৌ-ফতেহর হাটখোলার বাসায়, দুই গেরিলাকে না পেয়ে সেনারা বাড়ির জামাই বেলায়েত হোসেনকে ধরে নিয়ে যায়। বড় মগবাজারে আজাদের বাসা থেকে ধরে নেয়া হয় আজাদ, জুয়েল,বাশারসহ চার-পাঁচজনকে। পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে পেটে গুলি করা হয় আজাদের খালাতো ভাই টগরকে। ১৭ জন বঙ্গশার্দূলের মধ্যে ধরা পড়ে ১৫ জন।

সপ্তম পর্বঃ

মেলাঘর। দুই নম্বর সেক্টরের হেডকোয়াটার। খালেদ মোশাররফ আর এটিএম হায়দারকে ক্র্যাক প্লাটুনের ছেলেপুলের দুর্ধর্ষ সব অপারেশনের গল্প বলছেন শাহাদাৎ চৌধুরী। শুনছেন আর প্রচণ্ড খুশিতে চোখ-মুখ ঝলমল করছে দুই সেনানায়কের, শহিদুল্লাহ খান বাদল প্ল্যান করছেন ভারী অস্ত্র আর আরও বেশি গোলাবারুদ কবে পাঠানো যায় সেটা নিয়ে। নতুন আর্মসগুলো নিয়ে ৬ই সেপ্টেম্বরের আগেই পৌছাতে হবে , এটা ভাবতে ভাবতে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালেন শাচৌ। ধোঁয়াটা ছাড়তেই হঠাৎ খেয়াল হল পাহাড় থেকে ঝড়ের বেগে কেউ একজন নেমে আসছে। একটু সামনে আসতেই চেনা যায় মানুষটাকে, ফতেহ আলী চৌধুরী। রেগে যান শাচৌ, ঢাকার অপারেশন ফালায়া এইখানে কি তোর? ফতেহ সামনে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষনে তাঁবুর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে বাকিরা। ক্র্যাক প্লাটুনের প্রায় সবগুলো অপারেশনে অংশ নেওয়া দুর্ধর্ষ বীরযোদ্ধা ফতেহ আলীর চেহারাটা বিধ্বস্ত দেখায়। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে সে ধীরে বলে যায়, সব শেষ হয়ে গেছে স্যার। সব শেষ হয়ে গেছে। রেইড হইছিল, ওরা সবাই ধরা পড়ছে।
উপস্থিত মানুষগুলার উপর যেন হুট করে বজ্রপাত হয়। মেজর হায়দার হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে যায়, বাকিরা স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে ভয়ংকর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যন্ত্রণাটুকুও বোধহয় তাদের স্পর্শ করতে দ্বিধায় পড়ে যায়। অসামান্য দৃঢ় ভাবলেশহীন পাথর মেজর হায়দারকে পাওয়া যায় তাঁর তাবুতে, বালিশটা তুলে তাতে মুখ গুঁজে শিশুদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছেন তিনি, গুমরে গুমরে কান্নার শব্দের সাথে সাথে অস্ফূট শব্দ শুনতে পায় তাঁবুর বাইরের কেউ কেউ- মাই বয়েজ… মাই বয়েজ…
সেপ্টেম্বরে আবার প্রস্তুত হল গেরিলারা। ক্র্যাক প্লাটুনের ২য় পর্বের বিশাল দলটাকে পাঠানো হবে ঢাকার আশেপাশের থানাগুলোতে, আড়াইহাজার, নারায়নগঞ্জ, ত্রিমোহনী। তিনটা সেকশনে বিভক্ত করে তিন জন কমান্ডার চূড়ান্ত করা হল। মায়া, গাজি আর ফতেহ আলী। মেজর হায়দার তাদের ইন্সট্রাক্ট করতে বর্ডার চলে এলেন। অস্বাভাবিক গম্ভীর আর বিষণ্ণ হায়দার, ডাকলেন, ” ফতেহ , কাছে এসো”। ফতেহ সামনে এগিয়ে গেল, পিঠে হাট রেখে বিষাদে ঢাকা গলায় হায়দার বললেন, তোমার মনে আছে, একদিন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি সবচেয়ে ভালবাসো কাকে? ফতেহ বলল, জি স্যার, মনে আছে। হায়দার বলে চলেন, “তখন তুমি বললে, নিজের জীবনকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসো। কিছুটা অদ্ভুত লেগেছিল, কেউ তো এভাবে সরাসরি বলে না। বললাম, তাহলে যুদ্ধে এলে কেন? তুমি বলছিলা, সেইটা বাংলাদেশকে দিতে”। বলতে বলতে বুকে টেনে নিলেন ফতেহকে, শক্ত করে চেপে ধরলেন। ভারী গলায় হুকুম দিলেন, “জাস্ট ডোন্ট ডাই, দ্যাটস মাই অর্ডার”। বাধ্য সোলজারের মতো ফতেহ বলল, ইয়েস স্যার…

অষ্টম পর্বঃ

বিজয়ের আগ পর্যন্ত ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলারা ঢাকার আশেপাশে পাকিস্তানী সেনাদের উপর প্রবল প্রতাপে আক্রমন চালিয়ে গেল। মুক্তিবাহিনী আর মিত্রবাহিনীর আক্রমন, ইন্ডিয়ান এয়ারস্ট্রাইক, গেরিলাদের মুহুর্মুহু অ্যামবুশ। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী টিকতে পারল না, পালিয়ে গেল ঢাকা শহরের ভেতর। অবশেষে এল ১৬ই ডিসেম্বর, মেজর হায়দার আত্মসমর্পণের সময় থাকবেন শুনে ফতেহ আলী চৌধুরী তার যোদ্ধাদের নিয়ে কাদা জল, ঝোপ জঙ্গল ভেঙ্গে চলে এল ঢাকায়, স্যারের পাশে থাকবে। ১৭ই ডিসেম্বর সকালে রেডিও অফিসে চলে গেল আলম আর ফতেহ, সকাল ৮ টা ৪৫ মিনিটে পাক বেতার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বেতারের যাত্রা শুরু হল। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বিশেষ ঘোষণা পাঠ করলেন মেজর হায়দার। হায়দারের নির্দেশে আলম আর জিয়া সেন্ট্রাল জেল খুলে বন্দীদের মুক্ত করে দিল। তারপর সন্ধ্যায় একযোগে সবাই মিলে ঘেরাও করল ডিআইটি ভবন। ভবনে অবস্থিত টেলিভিশন সেন্টার দখলে নেবার পর প্রথমে পর্দার পর্দায় বড় করে লেখা উঠলো বাংলাদেশ টেলিভিশন। তারপর গেরিলা বাহিনীর প্রতি মেজর হায়দারের নির্দেশ ডিসপ্লে আকারে প্রদর্শিত হতে থাকলো স্ক্রিনে। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল ফতেহ আলী চৌধুরীকে। ফতেহ আলী বিশেষ ঘোষণা পাঠ করবার পর বিশেষ নির্দেশাবলী ও ঘোষণা পাঠ করলেন মেজর হায়দার,তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস। এই ইতিহাসের এক অন্যতম অংশ ফতেহ আলি চৌধুরী এরপর হঠাৎ হারিয়ে গেল, চলে গেল আড়ালে।

১৯৭১ সালের ১৭ই ডিসেম্বরের পর ফতেহ আলি চৌধুরীকে আর টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়নি। অনেক টেলিভিশন চ্যানেল তার সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছে, পত্রিকা তাকে নিয়ে করতে চেয়েছে রিপোর্ট, কিন্তু ফতেহ আলি রাজি হননি। অডিও কিংবা ভিডিও সাক্ষাতকারের জন্য অনুরোধ করলে রেগে যান তিনি, এক বিচিত্র ক্ষোভ বেরিয়ে আসে তাঁর ভেতর থেকে, হু অ্যাম আই? আমি কেন? আমার সাক্ষাৎকার কেন নিতে চাচ্ছ তোমরা? আই এম নট অ্যা হিরো। সত্যিকারের হিরো দেখতে চাও? সত্যিকারের হিরো ছিল তরু ওস্তাদ, মুনির ওস্তাদ, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুর্ধর্ষ সেনা ছিল তারা। সেক্টর টু-এর হাজার হাজার গেরিলা যোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছে ওরা, পাকিস্তানির সেনাদের সাথে চোখে চোখ রেখে ফাইট করছে। আজকে তারা কই? গ্রাম-বাংলার হাজার হাজার গ্রামে এমন অসংখ্য আনসাং(Unsung) হিরো আজ অবর্ণনীয় দুঃখ- কষ্ট যন্ত্রণায় জীবন কাটাচ্ছে , যারা সত্যিকারের বীর ছিল। পারলে তোমরা তাদের কাছে যাও, সাক্ষাৎকার নিতে হলে তাদের সাক্ষাৎকার নাও। এখানে কি চাও তোমরা? এক মুক্তিযোদ্ধা ভয়ংকরভাবে আহত হয়েছিল, গুলিতে তার পেট ঝাঁজরা হয়ে গেছে, তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, আপনার কিছু বলার আছে? আপনার পরিচয় দেন, আপনার বাড়ি কই? ঠিকানাটা বলেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় কোনমতে সে বললো, দুই নাম্বার সেক্টরেই আমার ভাই যুদ্ধ করে। ছোট বেলা থেকে সে আমারে ভিতু বইলা ক্ষেপাইত, বাপ-মা বহুত আফসোস করত আমার সাহস নাই বইলা। আপনি তারে খুঁজে বের করবেন। তারে বলবেন, আমি একলা কাভারিং ফায়ার দিছি, প্লাটুনের সবাই বাঁইচা গেছে। আপনি তারে বলবেন, আমি যুদ্ধ করতে করতে মারা গেছি। আমি ভয় পাই নাই। কথাটা শেষ করে সে আমার কোলেই মারা গেল। তোমরা এই ধরনের অসংখ্য আনসাং হিরোদের বের করো। হোয়াই মি? সুবেদার বেলায়েতের কথা লিখো, সুবেদার ওয়াহাবের কথা লিখো। এরা যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়েছিল। টর্চার সেলে ভয়ংকর নির্যাতন করা হয়েছিল রুমিকে, কিন্তু কোন তথ্য দেয় নাই রুমি, চোখে চোখ রেখে শুধু বলছিল, “You people are going to die. You can’t flee, you can’t leave-Nobody can save you- I can tell you this much”। ভয়ংকর মার খেয়েও বদি ঠাণ্ডা গলায় বলছিল, আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। ইউ ক্যান গো টু হেল… ওদের কথা বলো, আমার সাক্ষাৎকার নেয়ার কি হল? জীবন দিল জুয়েল, মরে গেল বকর, আর আমি এখন নিজেকে বীর বলে বাহাদুরী করবো? তোমরা ভাবছটা কি?

******* ********** ********** ********

ফতেহ আলি চৌধুরীরা এভাবেই নিজেদের আড়াল করে রাখতে চান, মুক্তিযুদ্ধের ব্রাদার এ্যাট আর্মসদের হারিয়ে এভাবেই তাদের মুহূর্তগুলো কাটে অসম্ভব আক্ষেপ আর যন্ত্রণায়।ইতিহাস কখনই লেখা যায় না, তবুও ইতিহাসের ধুলো পড়া পাতায় তাদের পরিচয় লেখা হয় কাঁচা হীরেয়, তাদের নামটা ইতিহাসের অধ্যায়ে উচ্চারন হয় আনসাং হিরো হিসেবে, চিরকাল।

আমার কথাঃ

অনুজপ্রতিম রা’দের লেখা এখানেই শেষ। লেখাটি পড়তে গিয়ে চোখ ভিজে উঠেছে বারবার, অঝোর ধারায় কেঁদেছি। ফতেহ আঙ্কেলের সাথে আমার পরিচয় তাঁর মেয়ে সিমিনের মাধ্যমে , বিশ্ববিদ্যালয়ে ও আমার সহপাঠী ছিলো। গত রোজার মাসে আংকেলের সাথে তাঁর বনানীর বাসায় প্রথম দেখা করি। সে সময়ে তিনি ক্র্যাক প্লাটুনের দুটি অপারেশনের কথা বলেছিলেন, আর ফোনে তাঁর সাথে আলাপের মাধ্যমে বেশ কিছু খুঁটিনাটি তথ্য পেয়েছি যেগুলো এই লেখায় যুক্ত করে দেবার প্রয়োজন বোধ করছি।

১) ক্র্যাক প্লাটুন নামটা কিভাবে এল?

কিংবদন্তী অনুযায়ী,মেজর খালেদ মোশাররফ এই আরবান গেরিলাদেরকে বলেছিলেন ঢাকা শহরে যেটুকু সম্ভব অপারেশন চালাতে যাতে পাকবাহিনী কিছুটা হলেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়। আর এই পাগলের দল করল কি, ঢাকা শহরের সবচাইতে সুরক্ষিত জায়গা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ( বর্তমান হোটেল শেরাটন) সামনে বোমা মেরে আসল। ওখানে তখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-এর মিশনের সদস্যরা অবস্থান করছিল। তারা তাদের রিপোর্টে পরিষ্কার উল্লেখ করে যে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক নয়- যেটা “স্বাভাবিক” দেখাতে পাক সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো। এই সংবাদ শুনে মেজর খালেদ মোশাররফ মেজর চোখ কপালে তুলে বলেন- “মাই গড, দিজ আর অল ক্র্যাক পিপল!” সেই থেকে এই দলটির নাম হয় ক্র্যাক প্লাটুন। তবে ফতে আলী চৌধুরী এই কিংবদন্তী সম্পর্কে মন্তব্য করেননি(তাঁর এটা জানার কথাও না, তখন তিনি ঢাকায়, অপারেশনে)। তিনি বলেছিলেন, মেজর খালেদ মোশাররফ এমন একটি দল চাইছিলেন যেটি কোন ব্যক্তির নামে ( জেড ফোর্স, কে ফোর্স ইত্যাদি) হবেনা, এটা হবে একেবারে হাত দিয়ে বাছাই করা সদস্যদের একটি অত্যন্ত স্পেশালাইজড বা ক্র্যাক টিম( আরবান ডিকশনারি অনুযায়ী ক্র্যাক শব্দটির একটি অর্থ অতিমাত্রায় বিশেষায়িত বা Highly Specialized )। মূলতঃ এই ধারণা থেকেই ক্র্যাক প্লাটুন নামটির উৎপত্তি। তবে লিজেন্ড সত্যি হোক বা না হোক, প্রথম ব্যাখ্যাটিও আমার পছন্দ। ক্র্যাক বা পাগল না হলে কি এরকম সাহস দেখানো সম্ভব?!

২) প্রথম প্লাটুনে এই ১৭ জনের ম্যাজিক ফিগারটা কিভাবে এল?এদের নির্বাচন করা হত কিভাবে?

তুর্কি যোদ্ধা ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি মাত্র সতের( মতান্তরে ১৮) জন অশ্বারোহী যোদ্ধা সংগে নিয়ে বাংলা জয় করেছিলেন। ক্র্যাক প্লাটুন গঠন করার সময় সদস্যদের মনোবল বাড়াতে ইতিহাসের এই গল্পটি তাদের শোনানো হয় এবং বলা হয়, “ তোমরা এই সতের জন মিলেই দ্বিতীয়বার বাংলা জয় করবে”। যেহেতু ঢাকায় অপারেশন করতে হবে, মূলতঃ দুটো বিষয়ের দিকে নজর দেয়া হয়েছিলোঃ

ক) ঢাকার স্থানীয় ছেলে হতে হবে, যারা ঢাকার অলিগলি চেনে। এরকম হলে অপারেশনের পর দ্রুত উধাও হয়ে যাওয়াটা সহজ হবে।

খ) কথাবার্তা, ট্রেনিং ইত্যাদিতে চৌকষ বা স্মার্ট হতে হবে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকা লাগবে যাতে বিপদ বুঝে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে । ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক সদস্যই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডি এম সি বা বুয়েটের ছাত্র, যারা ঢাকা শহর নিজের হাতের তালুর মত চিনতো।

ইতিহাসে বখতিয়ার খলজির অবস্থান যা-ই হোক না কেন, ফতেহ আংকেলের দেয়া এই তথ্যটি লেখায় সংযুক্ত করার প্রয়োজন অনুভব করেছি, একেবারেই নতুন এই বিষয়টি।

৩) শহীদ আবু বকরের কথা বারবার বলছিলেন ফতেহ আংকেল। ১৮ বছর বয়েস, রাজপুত্রের মত চেহারা, সেই সময়ে গুলশানে বাড়ি, বাবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। বিপদ এড়ানোর সব রকমের সুযোগ থাকার পরেও সব ছেড়েছুড়ে ও চলে আসল যুদ্ধে- দেশমাতার ঋণ শোধ করার শপথ নিয়ে। ওর একেবারেই নিষ্পাপ চেহারা আর অল্প বয়েস খুব কাজে লাগত গেরিলাদের। ট্রেনিং থেকে শুরু করে পুরোটা সময় ফতেহ চৌধুরীর ভক্ত হয়ে গিয়েছিলো ও, উনি যেখানেই যেতেন ও তার সংগে সংগে ছায়ার মত সে ও লেগে থাকত।প্রথম প্রথম সরাসরি যুদ্ধে ওকে যেতে দেয়া হত না, কিন্তু একই রকমের গুরুত্বপূর্ণ এবং বিপজ্জনক কিছু কাজে ও ছিলো আলটিমেট চয়েস।এরকম একটা কাজ ছিলো ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্সের পূর্ব পাকিস্তান চ্যাপ্টারের সিনিয়র বাংগালী অফিসার গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইসলামকে পরিবারসহ ভারতে পৌঁছে দেয়া। এই অফিসার পাক ইন্টেলিজেন্সের অন্যতম সিনিয়র অফিসার হলেও হলেও বাংগালী বিধায় পাকিরা তাকে বিশ্বাস করতোনা, কঠোর নজরদারীতে রাখতো।এই ভদ্রলোক পরিবারসহ একটা বিয়ে খেতে এসে সেখান থেকে ক্র্যাক প্লাটুনের এক জ্যেষ্ঠ মেম্বারের সহায়তায় পালিয়ে এসে বাসাবোতে একটা সেইফ হাউজে উঠলেন।সেখানে তাঁর সাথে যোগাযোগ হয় বকরের, ফতেহ আর বকরের দায়িত্ব পড়ে তাঁকে ভারতে পৌঁছে দেবার।এদিকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন ইসলাম(পরবর্তীতে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের এয়ার ভাইস মার্শাল ) নিখোঁজ হবার পর পাগলা কুকুর হয়ে ওঠে পাকিস্তানিরা, হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে তাঁকে।কারণটা স্বাভাবিক, যিনি ইন্টেলিজেন্সের এত সিনিয়র অফিসার, তাঁর কাছে ওরা নতুন তথ্য না দিলেও ইতোমধ্যে দেয়া বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তো ছিলোই- সেগুলোও যুদ্ধে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে সক্ষম হত। আমাদের দুই “ক্র্যাক” (তারছেঁড়া অর্থে) সদস্য, যাদের বয়েস যথাক্রমে ১৮ এবং ২২, সিদ্ধান্ত নিলো এরকম বিপজ্জনক একজন সংগীকে তার পরিবারসহ নিয়ে যাবে ঢাকার বুক থেকে সোজা ভারতে, সব রকমের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে। পাঠক, কল্পনা করুন তো, যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে সেখানের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্টের কর্নেল র‍্যাংকের একজন আপনাদের পক্ষে কাজ করার জন্যে পালিয়ে এসেছেন , আর আপনার দায়িত্ব হচ্ছে তাঁকে তাঁর স্ত্রী আর শিশুপুত্রসহ বর্ডার পার করে দেশের বাইরের ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া। স্বয়ং মাসুদ রানাও রীতিমত গর্ববোধ করত এরকম একটা মিশন সাকসেসফুল করতে- এটা বুঝতে রকেট সায়েন্টিস্ট হবার প্রয়োজন পড়েনা। আমাদের সুপারহিরো ফতেহ আলী চৌধুরী আর তাঁর সংগী বাকের এই কাজটা করেছিলো,পরিবারসহ এভিএম ইসলাম সাহেবকে নিয়ে গিয়েছিলো ভারতের সোনামূড়াতে, যেখানে মুক্তিবাহিনীর একটি মেডিকেল ইউনিট অবস্থিত। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন (ডাক্তার) আখতার এলেন, তিনি খবর দিলেন মেজর খালেদ মোশাররফকে।মেজর খালেদ মোশাররফ ফোনে কি কি জানি ইন্সট্রাকশন দিলেন- পুরো এলাকা গরম হয়ে উঠল। কিছুক্ষণের ভেতরেই ভারতের ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং এলেন, সংগে ডজনখানেক উচ্চপদস্থ অফিসার। প্রথমে তাঁরা কেউ বিশ্বাস করতে পারেননি এরকম একটা কান্ড ১৮ আর ২২ বছর বয়েসি দুটো বাচ্চা ছেলে ঘটাতে পারে,এত এত চেকপোস্ট ফাঁকি দিয়ে এরকম হাই প্রফাইল কাউকে বর্ডার পার করে দিতে পারে। ব্যাপারটা এতটাই অবিশ্বাস্য ছিলো যে ফতেহ আর বকরকে আলাদা আলাদা করে জেরা করা হল, নেয়া হল আলাদা আলাদা লিখিত স্টেটমেন্ট। যাচাই বাছাই শেষে সত্যতা প্রমাণের পর ভারতীয় অফিসাররা এভিএম ইসলাম সাহেবের নিরাপত্তার খাতিরে তাঁকে নিয়ে রাখলেন রেড ফোর্টে, সেখান থেকে পাকিস্তানের যাবতীয় ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করল মিত্রবাহিনী।। ডেপুটি স্পীকার শওকত আলী তখন আশেপাশেই ছিলেন, তিনি ফতেহকে ডেকে বললেন- “ ফতে, তুই এইটা কি করছোস!!!! দিলি তো ব্যাটা পাকিস্তান আর্মির বারোটা বাজায়ে!!এই অসম্ভব কাজ তুই কেমনে করলি?”

এই ৪৩ বছর পরে অতি সাধারণ বংগসন্তান আমারও একই প্রশ্ন- “আংকেল, এই অসম্ভব কাজ কিভাবে করলেন?”
উত্তর পাননি শওকত আলী, উত্তর পাইনি আমিও, তবে ফতেহ আংকেলের মৃদু হাসির শব্দ কিছু না বলেও অনেক কিছু বলে ফেলেছিলো। একাত্তর আসলে ছিল এক রূপকথার সময়, আর সেই রূপকথার জিয়নকাঠির ছোঁয়াতে ফতেহ আলীরা হয়ে উঠেছিল একেকজন মৃত্যুঞ্জয়ী রাজকুমার, তলোয়ার হাতে পংখীরাজ ঘোড়ায় যারা সংহার করেছিল বাংলার নরম মাটিতে থাবা বসানো পিশাচ আর দানবের দলকে।
যতই বীরত্ব দেখাক না কেন, বাস্তব জীবন তো আর হলিউড মুভি না- ভয় সবারই লাগে। এরকম দুর্বল মুহূর্তে বকর সব সময় ফতেহ চৌধুরীর কাছে সাহস নিতে চেষ্টা করত। ফতেহ অভয় দিয়ে বলতেন, চিন্তা করিস না বকর, আমি থাকতে কোন কিছু তোকে ছুঁতেও পারবেনা। ২৯ আগস্টের অল্প কিছুদিন আগে বড় একটা অস্ত্রের চালান নিয়ে বেংগল রেজিমেন্টের কিছু লোকদের সাথে করে ত্রিমোহনীতে আসে বকর আর ফতেহ, গুরু আর শিষ্য।দুজন কি কারণে আলাদা হয়ে গিয়েছিলো সেদিন, বকর আগেই গিয়েছিলো ফকিরবাড়ি নামের একটা জায়গায়, অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখতে। হায়, এই বিচ্ছেদই হল কাল, ক্র্যাক প্লাটুনের বাকি সদস্যদের মত বকরও ধরা পড়ল ২৯ আগস্টে। “ মাসরুফ, কথা দিয়েছিলাম আমি জীবিত থাকতে আমার সাথে থাকলে ওর কিচ্ছু হবেনা-। কিন্তু আমার বকর মারা গেল সেই একাত্তরে, কই এই ৪৩ বছর ধরে আমি তো দিব্যি বেঁচে আছি। বকর, ভাই আমার, তোকে বাঁচাতে পারলামনা…” ফতেহ আংকেল ফোনে এ কথাগুলো বলছিলেন। একাত্তরের ২২ বছরের প্রাণোচ্ছ্বল তরুণ ফতেহ আলী চৌধুরী আজ অসম্ভব রাশভারী মানুষ, আবেগ বুঝতে দেননা- কিন্তু হাজার মাইল দূরে বসে তাঁর হাহাকার শুনে কার সাধ্য চোখের পানি আটকে রাখে! “আংকেল, আমাকে দুই মিনিট দিন”- এই বলে চোখের পানিটুকু মুছে নিলাম

৪) সরাসরি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন কখনো, আংকেল? জিজ্ঞাসা করেই নিজের উপর খুব রাগ হল, ক্র্যাক প্লাটুনে যোগদানটাই তো মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য বানানোর সামিল! তবে তিনি নিরাশ করলেন না।বলতে শুরু করলেন রোমহর্ষক এক গল্পঃ

“২৯ আগস্ট ক্র্যাক প্লাটুনের সবাই ধরা পড়ার পর রক্ত উঠে যায় আমার মাথায়- প্রতিশোধ নিতে হবে। এবার আরো বড় দল নিয়ে মেজর হায়দারের নির্দেশে বাংলাদেশে আসি আমরা- ঢাকার আশেপাশে অপারেশন চালাতে। প্রথমে আমরা ঘাঁটি গাড়ি রূপগঞ্জে।একদিন হঠাৎ সুযোগ পেয়েও গেলাম,একটু দূরে ডুমনী বাজারে। ওখানে দেখি জনাদশেক পাকসেনা বাজার থেকে জিনিসপত্র নিতে এসেছে।ওরা কিছু বোঝার আগেই গুলি চালালাম- আমার সাথে অন্যরাও ছিলো। বাজার করতে আসা পার্টি ওখানেই খতম , আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটলাম নিজ অবস্থানে।বুঝতে পারছিলাম, ওরা ভোররাতের দিকে সর্বশক্তিতে আমাদের আক্রমণ করবে।

সিকোয়েন্সটা ছিলো এরকমঃ আমাদের আক্রমণ(ডুমনী), এর প্রতিক্রিয়ায় ভোররাতে আমাদের ওপর ওদের আক্রমণ- এবং সেটা আগে থেকেই আঁচ করে ওদের আক্রমণের পথে আমাদের এ্যামবুশ। মাথামোটা পাকসেনারা কঠোর সামরিক ট্রেনিং পেলে কি হবে, আউট অফ দা বক্স চিন্তা করার ক্ষমতা ওদের ছিলনা, যেটা ছিলো আমাদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। গর্ধবগুলোর মাথায় কি চলছে কিছুদিন যুদ্ধ করার পর আমরা মোটা্মুটি ছকে ফেলার মত করে অনুমান করতে পারতাম। রোজার সময়ে সারাদিন ইছাপুর বাজারে ঢোকার পথগুলোতে এ্যামবুশ পেতে বসে আছি, কিন্তু হায়েনাগুলোর দেখা নেই।এভাবে বসে থাকতে থাকতে ভীষণ ক্ষুধা লেগে গেল। আমি তখন অস্ত্রসহই এ্যামবুশ পজিশন থেকে বেরিয়ে বাজারের ভেতরে গেলাম। একটা দোকানের কাছে গিয়ে হঠাৎ দেখি খাকী পোশাক পরা কে জানি আমার দিকে পিঠ দিয়ে এলএমজি(লাইট মেশিন গান) পজিশন ঠিক করছে। স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি হারিয়ে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলঃ কে????????? সংগে সংগে পাকি সৈন্যটা আমার দিকে ফিরল। তবে ওই ব্যাটা ট্রিগারে চাপ দেবার আগেই ওর গায়ে পুরো ম্যাগজিন খালি করলাম।গুলির শব্দে চারিদিকে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল, আমি দৌড়ে পালাতে লাগলাম। ইছাপুর বাজারের ভেতরে হাঁটুপানির একটা খাল ছিলো, ওটাতে পড়লাম, পেছন থেকে আমাকে ধাওয়া করছিলো পাকসেনারা। এদিকে দলের লোকজনের কাছে বাজারের লোক খবর দিলো আমাকে পাকিস্তানিরা ধরে ফেলেছে, আর বিরাট পাকসেনার দল বাজারে আক্রমণ করেছে।

এদেশী রাজাকারের বাচ্চারাই পাকিদেরকে আমাদের এ্যামবুশ ফেলে রাখা সাধারণ রাস্তাগুলো না দেখিয়ে অলিগলি চিনিয়ে দিয়েছিলো, যার ফলে এ্যামবুশ পেতে লাভ হয়নি। আমার সহযোদ্ধা ছিলো বক্সার আইউব, কাশেম আনসারী, আউয়াল, আজিজ, গায়ক আজম খান এবং তৎকালীন আনসার বাহিনীর একজন কমান্ড্যান্ট। গোলাগুলির শব্দ শুনে একদল গেল আর্মস রক্ষা করতে, আরেকদল গেল শত্রুপক্ষের এ্যাডভান্স আটকাতে। এল এম জি দিয়ে কভার ফায়ার দেবার কথা উঠতেই ধমকে উঠলাম, মাত্র দুটা এল এম জি, কোন অবস্থাতেই শত্রুপক্ষের হাতে পড়তে দেয়া যাবেনা। সহযোদ্ধারা একযোগে ইছাপুর বাজারে চলে আসা পাক আর্মির উপর পাল্টা আক্রমণ করায় সেদিন ভাগ্যক্রমে রক্ষা পাই আমি”।

৫) স্বাধীন বাংলাদেশের টেলিভিশন বিটিভিতে ঘোষণা দেয়া প্রথম মানুষটি যে ফতেহ আলী চৌধুরী এটা আগেই আমরা জেনেছি।

ফতেহ আলী চৌধুরীর প্রারম্ভিক ঘোষণার পরেই মেজর এটি এম হায়দারের ঘোষণার স্থিরচিত্র নীচে দেয়া হলঃ



দুটি ছবিই হাবিবুল আলম বীরপ্রতিক রচিত “ব্রেভ অফ হার্ট(২০১০)” বইটি থেকে নেয়া।

২০০৮ সালে জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক আসরার চৌধুরী(যিনি আমারও সরাসরি শিক্ষক) বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ডেইলী স্টারের পক্ষ থেকে গেরিলা ফতে আলী চৌধুরীর একটি ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। এ প্রসংগে আসরার চৌধুরী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন,

“I was just the rubber-stamp of history. If I weren’t there that day, somebody else would have done what I did. In the words of my friend, the noted singer Azam Khan, I want to say ‘’Today Bangladesh is free. And this is my achievement.’”

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে কৃত্রিম বিতর্কের এই যুগে তাঁর এই দৃপ্ত , অসংকোচ উচ্চারণ কেন জানি বড় অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগে!

শেষের কথাঃ

ক) এবছরের শুরুতে সরকারী কাজে ইউরোপ গিয়েছিলাম, ফেরার পথে পড়েছিলো ইস্তানবুল। ১৪৫৩ সালে সুলতান মেহমেত দি সেকেন্ড ইস্তানবুল জয় করেন।তাঁর সমাধি যেখানে, সে জায়গাটিতে একটি মসজিদ স্থাপন করা হয় যার নাম জা’মি ফাতিহ। এই মসজিদের উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল প্রায় পাঁচ বছর আগে প্রতিশ্রুত একটি ব্লগ লেখার কথা। স্থানীয় তুর্কি গাইডকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম “ফাতিহ” ( বা ফতেহ) শব্দটির অর্থ বিজয়ী, যেটি আমাদের বীর ফতেহ আলী চৌধুরীর নামের সাথে হুবহু মিলে যায়। সে মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিই বিস্মৃত এই বীরকে আমার সাধ্যমত ফিরিয়ে আনব লোকচক্ষুর আড়াল থেকে, লিখে নেব তাঁর বীরত্বের কাহিনী, যেন আমার সন্তানাদি এই বীরদের গল্প শুনে অনুপ্রাণিত হয়, উজ্জীবিত হয় হয় স্বদেশপ্রেমের অগ্নিমন্ত্রে। সহোদর না হয়েও সহোদর রাআদ রহমানের প্রতি কৃতজ্ঞতা, ওর কারণেই এই লেখাটি আলোর মুখ দেখতে পেল। শুরুতে একবার বলেছিলাম, আবারও বলি, রাআদ না থাকলে এ লেখাটি দাঁড় করানো ছিল অসম্ভবের কাছাকাছি।

খ) ফতেহ আলী চৌধুরী, যাঁর নামটির অর্থই বিজয়ী , যুগে যুগে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে যাবেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে- এ লেখাটির উদ্দেশ্য মূলতঃ এটিই। আজ থেকে দশ বা বিশ বছর পরে হয়ত প্রত্যক্ষ মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়া কেউ আর আমাদের মাঝে থাকবেন না, তাই আমরা যে যেখানে আছি সেখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধা কাউকে পাওয়ামাত্র তাঁর গল্পটুকু লিখে রাখতে পারি। দেশমাতৃকার কাছে প্রতিটি প্রজন্মের একটি দায়বদ্ধতা থাকে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে দেশকে স্বাধীন করার মাধ্যমে তাঁদের দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন। আমরা যারা বর্তমান প্রজন্ম, আমাদের দায়িত্ব এই দেশটাকে ঠিকঠাক গড়ে তোলা- যে সোনার বাংলা গড়তে তাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন সেই সোনার বাংলা ইঁটের পরে ইঁট সাজিয়ে আক্ষরিক অর্থেই দাঁড় করানো। আমরা জানি আমাদের দেশটা হাজার হাজার সমস্যায় জর্জরিত, একেকটা দিন পার করা প্রায় যুদ্ধ লড়ার মতই কঠিন হচ্ছে দিনকে দিন। তবুও, কোনও দেশ কি আর জন্ম থেকেই পারফেক্ট হয়? ওটাকে পারফেক্ট বানাতে হয়- আর এই কাজটা করার দায় আমাদের প্রত্যেকের, নিজ নিজ অবস্থান থেকে যেটুকু পারি সেটা নিষ্ঠার সাথে করার মাধ্যমে-শুরুতে উল্লেখ করা রবিঠাকুরের ওই কবিতার মতঃ “আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি”

জাতীয় গৌরব না থাকলে কোন জাতি বড় হতে পারেনা, আর মহান মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে পৃথিবীর বুকেই একটি গৌরবোজ্জ্বল নক্ষত্র- সূর্যের মত যে নক্ষত্রটি পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশের মানুষকে অনুপ্রেরণা যোগায়। মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, When we are cut, we bleed red and green.

প্রিয় পাঠক, এই মহাভারতসম লেখাটির এতদূর পর্যন্ত যেহেতু পড়েছেন কষ্ট করে, বিনীতভাবে একটা অনুরোধ করি? ২০১৪ সালের মহান বিজয় দিবসে চলুন না একটা প্রতিজ্ঞা করি! আগামী এক বছরে আশেপাশে যদি কোন মুক্তিযোদ্ধা দেখতে পান, তাঁর যুদ্ধের গল্পটি শুনুন, এবং নিজের ভাষায় লিখে রাখুন। জেনে নিন তিনি কোথায় যুদ্ধ করেছেন, কার অধীনে- কোন সেক্টরে, তাঁর জীবিত ও মৃত সহযোদ্ধাদের কথা জিজ্ঞাসা করুন। ঢাকা সি এম এইচে এক শীর্ণকায়, রোগাক্রান্ত বৃদ্ধ একবার আমার কাছে মোবাইল ফোনটি ধার চেয়েছিলেন। অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফোনটি তাঁকে দিলাম, ভদ্রলোক ফোন করে সম্ভবত তাঁর মেয়েকে ডাক দিলেন। আমার বিরক্তি দেখে ফোন রাখার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “বাজান , আপনি কি করেন?” “সরকারী চাকুরি করি”- রীতিমত কঠোর সুরেই তাঁকে বলেছিলাম। এরপরে তিনি যেটি বললেন তাতে আমার ইচ্ছে হয়েছিল লজ্জায় ইঁদুরের গর্তে মুখ লুকোতে। “ বাজান, আমি একাত্তরে যুদ্ধ করসি, দেশটা স্বাধীন কইরা দিসি আপনাদের, এরে দেইখা শুইনা রাইখেন”
যে মানুষগুলো না থাকলে আমাদেরকে স্বাধীন দেশের ঘি মাংস খাবার বদলে পাকিস্তানি প্রভূদের পদলেহন করতে হত, সেই মানুষগুলোর খুব অল্প ক’জনের সাথেই আপনার দেখা হবে এসি রূমের বিলাসিতায়। এঁদের বেশিরভাগকে আপনি পাবেন এরকম হঠাৎ করে, জীর্ণ-শীর্ণ রূপে। কিন্তু একবার তাঁদেরকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন একাত্তরের রণাংগনের কথা, দেখবেন ওই অশীতিপর বৃদ্ধের চোখে কি এক অপার্থিব আলো খেলা করছে, যে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছেন আপনি এবং আপনার চারপাশ।এই আলোটুকুর কিছুটা হলেও স্বীয় লেখনির মাধ্যমে ধরে রাখুন, প্লিজ! এটুকু আশা কি পুরো এক বছরে আপনার দেশ আপনার কাছে করতে পারেনা?

সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা!

পরিশিষ্টঃ

১) দি ট্রেইন ( ১৯৬৪) মুভিটার কথা মনে আছে? ওই যে, যেটার শেষ দৃশ্য দেখে ফতেহ আলী চৌধুরী যুদ্ধে যাবার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন( দ্বিতীয় পর্ব দ্রষ্টব্য)? এই নিন শেষ দৃশ্যের ভিডিও লিংকঃ

https://www.youtube.com/watch?v=1-u3uYmSpkg

মুভিটির পরিচালক এবং অভিনেতা অভিনেত্রীরা কখনো জানবেন না, তাঁদের এই সিনেমাটি বাস্তব জীবনে একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে কি অবদান রেখেছিল!

২) একাত্তরের গেরিলাদের , বিশেষ করে ২ নম্বর সেক্টরের মেজর খালেদ মোশাররফের কার্যক্রম দেখতে “মেজর খালেদ’স ওয়ার” নামের এই ডকুমেন্টারিটি সকল বাংলাদেশীর জন্যে দেখা অবশ্যকর্তব্য। বিরল এই ডকুমেন্টারিতে গেরিলাদের সরাসরি যুদ্ধের ফুটেজ রয়েছে।

https://www.youtube.com/watch?v=dK3x29y-Fz4

এখানের মাঝামাঝি সময়ে বিদেশী সাংবাদিকের সামনে নিখুঁত ইংরেজিতে কিশোর যে ছেলেটি মেজর খালেদের কাছ থেকে ম্যাপ বুঝে নিচ্ছে, অনেকের মতে ইনিই তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের ছাত্র এবং আমাদের সুপারহিরো ফতেহ আলী চৌধুরী। তথ্যটি পুরোপুরি নিশ্চিত নয়, তবে তাতেও ক্ষতি নেই, ভিডিওটি অবশ্যই দেখা প্রয়োজন।

৩) অনেকেই জানেননা, মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের প্রায়শঃই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতেন/সরাসরি নানাভাবে সহায়তা করতেন সেযুগের অত্যন্ত স্মার্ট এবং সুশিক্ষিতা নারীরা। ফতেহ আলী চৌধুরী বেগম জাহানারা ইমাম এবং শাহীন নাম্নী আরেকজন মহীয়সী নারীর কথা উল্লেখ করেছেন। এঁরা তাঁদের গাড়িতে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের বসিয়ে পাকসেনাদের চোখে ধুলো দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দিতেন। আজকের স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি যে মেয়েদেরকে ঘরের ভেতরে আটকে রাখতে চায় এটা তো খুব স্বাভাবিক! হিস্টরি রিপিটস ইটসেলফ, আর এ কারণেই একাত্তরেও ওই হায়েনার দল জিততে পারেনি, এবারও পারবেনা।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

১) সিমিন চৌধুরী , বীর মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরীর কন্যা এবং প্রিয় সহপাঠিনী। ও না থাকলে আমার বা রাআদের কারো পক্ষেই এই বীরের সাক্ষাৎকার নেয়া সম্ভব হতনা।

২) অমি রহমান পিয়াল, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক। ডেইলি স্টারে ২০০৮ সালে ফতেহ আলী চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের লিংক এবং মেজর খালেদ’স ওয়ার ডকুমেন্টারিটি তাঁর মাধ্যমেই পাওয়া।

৩) পরমা কন্যা, বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। “When We Are Cut, We Bleed Red And Green”- এই উক্তিটি ওর।

৪) তারিক লিংকন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এবং রাআদের সাথে ফতেহ আলী চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের অন্যতম সঞ্চালক।

৫) আসরার চৌধুরী, শ্রদ্ধেয় শিক্ষক , অর্থনীতি বিভাগ, জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।




Courtesy: সভ্যতা ব্লগ, ডন মাইকেল করলেওনে

Tuesday, December 9, 2014

স্বপ্ন

দৃশ্যপট -১
বাবার রুমের সামনে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে ছেলেটা, প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে। অনুশোচনা আর অনুতাপের আগুনে পুড়ছে সে, ক্ষমা চাওয়া তো দূরে থাক, কিভাবে বাবার সামনে দাঁড়াবে, সেটাই বুঝতে পারছে না। ক্রিকেটটা দুইজনেই প্রানের চেয়েও বেশি ভালবাসে, তবে তার বাবার চাওয়াটা আরও বিস্তৃত । ছেলে ক্রিকেটার হবে, জাতীয় দলে ওপেনিংয়ে ব্যাট করতে নামবে, এই স্বপ্নটুকু সফল করতে গত কয়েক বছর দিন রাত খাটছেন বদিউল আলম। ঠিক এখানেই ঘোর আপত্তি ছেলের, পরিশ্রম বা খাটাখাটনি ব্যাপারটায় একেবারেই আগ্রহ নাই তার।
অথচ মারকুটে ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিভাটা জন্মগত তার, কিন্তু ফুটওয়ার্কে গোলমাল আর শর্ট বলে দুর্বলতাটা খুব চোখে লাগছে ইদানিং। প্রতিদিন ভোরে ছেলেকে তুলে দেন বাবা। যেন সে প্র্যাকটিসে একটু আগে আগে গিয়ে এটা নিয়ে বাড়তি কাজ করে, বড্ড একঘেয়ে আর বিরক্তি লাগে ছেলেটার। গতকাল এই নিয়েই কথা কাটাকাটি, সাত সকালে ঘুম থেকেই উঠেই ছুটতে পারবে না সে। মেজাজ হারিয়ে ফেললেন বাবা, উঁচু গলায় বকা শুনে রেগে গেল ছেলেও। “ খেললাম না তোমার বালছালের ক্রিকেট, কি করবা তুমি? “ কথাটা শুনে নির্বাক কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন বাবা, আর একটা কথাও বললেন না, বেরিয়ে গেলেন ওর রুম থেকে। মাথা ঠাণ্ডা হবার পর নিজেকে লাত্থি মারতে ইচ্ছে হয়েছে ছেলেটার, কিভাবে সে বলতে পারল কথাটা? সে কি জানে না, এই মানুষটা তার জন্য কি ভয়ংকর পরিশ্রম করছে?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হুট করে পর্দা সরিয়ে ঢুকে গেল ছেলেটা, বাবার পা’টা জড়িয়ে ধরবে আজ। ঢুকেই এক বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়ল তার, জানালার পাশে কালো কাপড়ে ঢাকা যে ছবিটা ছিল, সেটা থেকে কাপড়টা সরে গেছে। রাজপুত্রের মতো চেহারার একটা ছেলে, হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে আছে,সামনে নিশ্চল দাড়িয়ে বদিউল আলম। ধীরপায়ে বাবার পাশের গিয়ে দাঁড়াল ছেলেটা, আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, উনি কে বাবা?
--- “ও আমার বন্ধু।“ ধীরকণ্ঠে বলতে শুরু করেন বাবা। “ওর নাম জুয়েল, আবদুল হালিম খান জুয়েল। ছোটবেলা থেকে প্রচণ্ড ডানপিটে ছিল ও, দুষ্টুমিটা ছিল ওর ধ্যানজ্ঞান। একটু বড় হতেই অবশ্য সেটা ক্রিকেটে বদলে গেল। সারাদিন কেবল ক্রিকেট আর ক্রিকেট। খেলতোও সেইরকম। আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ওপেনিংয়ে নামতো, ৪৫ ওভারের ম্যাচ। ধুমধাড়াক্কা বাইড়ানির চোটে বিপক্ষ দল চোখে অন্ধকার দেখত, নাকের জল-চোখের জল এক হয়ে যেত বোলারদের। স্লগ সুইপটা অসাধারন খেলত, বল জিনিসটা যে পেটানোর জন্য, এইটার সবচেয়ে বড় উদাহরন ছিল ওর ব্যাটিং। উইকেট কিপিং করত, মাঠ মাতিয়ে রাখতো সবসময়। জন্মরসিক ছিল শালা। একটা জুটি দাঁড়ায়ে গেছে, উইকেট পড়তেছে না, দেখা গেল উইকেটের পিছে দাঁড়ায়েই বান্দা একের পর এক রসিকতা করে যাইতেছে। বেচারা ব্যাটসম্যান হাসতে হাসতেই আউট... কি বিপদ, দেখোতো...
বলতে বলতে গর্বের হাসি ফুটে ওঠে আলম সাহেবের মুখে, অবাক বিস্ময় ছেলের চোখে, “উনার আর আমার নাম তো একেবারেই এক, আমিও তো ওপেনিংয়ে ব্যাট করি। অথচ তুমি তার সাথে দেখা করায়ে দেওয়া তো দূরে থাক, তার ছবিটা পর্যন্ত দেখতে দাও নাই এতদিন...” অভিমানে গাঢ় শোনায় ছেলের গলা...
মলিন হয়ে গেল পিতার মুখ, কোথেক্কে চাপা এক বিষাদ ভর করল তার গলায়, “স্টেডিয়ামে ওর স্লগ সুইপ দেখে এক পাকিস্তানী কোচ বলছিল, “’ও এইখানে কি করতেছে? ওর তো ন্যাশনাল টিমে চান্স পাওয়ার কথা। ‘“ সত্যিই জুয়েলের জাতীয় দলে চান্স পাওয়ার কথা ছিল, পাকিস্তানের সেরা ওপেনার ছিল ও। কিন্তু ও যে বাঙ্গালী , তখন পাকিস্তানে একটা বাঙ্গালী কুকুরবিড়ালের চেয়েও নিকৃষ্ট ছিল। ১৯৭১ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি। কমনওয়েলথ টেস্টে পাকিস্তান টিমের ওপেনার হিসেবে রকিবুল হাসান নামলো, প্রথম বাঙ্গালী ক্রিকেটার, ব্যাটের উপর ভুট্টোর নির্বাচনী প্রতীক সোর্ডের পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা আর জয় বাঙলা লেখা স্টিকার জ্বলজ্বল করতেছে। এইটা দেখে স্টেডিয়ামে তো কেবল জয় বাঙলা আর জয় বাঙলা গর্জন। বেলা একটায় ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলো, রেডিওতে এই ঘোষণা শুইনা কাজী কামাল চিল্লায়া উঠলো, ইয়াহিয়ার ঘোষণা, মানি না, মানবো না। পাশ থেকে গলা মিলাইলাম আমরা, জুয়েল, রুমি, বাশার, হ্যারিস- বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো... খেলা তো সেইখানেই পণ্ড, আমরা রাস্তায় নাইমা আসলাম, জনতার লাভাস্রোত...
---তারপর কি হইল, বাবা? খুব ধীর গলায় জিজ্ঞেস করে ছেলেটা।
--- ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী হায়েনাগুলা ঝাঁপায়ে পড়ার পর বাঙ্গালী হতবুদ্ধি হইয়া গেল। দুঃখ না, কষ্ট না, মানুষ বিস্ময়ের ঘোর কাটায়ে উঠতে পারতেছিল না। এইটা কি হইল? আমাদের মধ্যে প্রায় সবাই তখনও বাইচা আছি, কিন্তু মুশতাক ভাইয়ের কোন খোঁজ নাই। জুয়েল ২৭ তারিখ আশরাফুলরে নিয়ে বাইর হইয়া গেল। ঢাকা জেলা ক্রীড়া ভবনের সামনে আসতেই ওরা মুশতাক ভাইরে খুইজা পাইল। বুলেটে বুলেটে ঝাঁজরা বুকটা, নির্বিবাদী , সদা হাস্যজ্বল মানুষটার নিষ্প্রাণ দেহটা খোলা আকাশে নিচে পড়ে আছে। আজাদ বয়েজ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা মুশতাক ভাইয়ের আপন শত্রুও এই অপবাদ দিতে পারবে না যে, তিনি কাউরে কোনোদিন একটা গালি দিছেন বা কোন ক্ষতি করছেন। রাত নাই, দিন নাই, খালি ক্রিকেট নিয়া পইড়া থাকতেন। বিনা অপরাধে এইভাবে মরতে হবে, এইটা হয়তো তার কল্পনাতেও ছিল না। নিষ্প্রাণ চোখ দুইটাতে তাই নিখাদ বিস্ময়। মুশতাক ভাইয়ের সেই দৃষ্টি জুয়েলেওর মাথায় গাঁইথা গেল, ব্যাট ফালায়া তুইলা নিল স্টেনগান, পাকি শুয়োরগুলারে মারতে হইব, দেশটারে স্বাধীন করতে হইব...
---তারপর? স্তব্ধ গলায় প্রশ্ন করে ছেলেটা।
--- খেলার মাঠে মারকুটে ব্যাটসম্যান জুয়েল ছিল প্রচণ্ড বুদ্ধিদীপ্ত, সাহসী আর ঠাণ্ডা মাথার এক যোদ্ধা। মেলাঘরে মেজর খালেদ মোশাররফ আর ক্যাপ্টেন এটি এম হায়দারের কাছে দুই মাস ট্রেনিং নিয়া জুলাইয়ে আমরা ঢাকায় আইসা হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে গেরিলা আক্রমন শুরু করলাম। আমাদের তারছিঁড়া কর্মকাণ্ডে ক্ষেইপা গিয়া খালেদ মোশাররফ আমাদের নাম দিছিলেন ক্র্যাক প্লাটুন। ফার্মগেট চেকপোস্ট অপারেশন, দারুল কাবাব অপারেশন, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্ট অপারেশন ইত্যাদি বেশ কয়েকটা অপারেশনে পাইক্কাগুলার পুরা জান কাঁপায়া দিলাম। জমের মতো ভয় পাইত তখন আমাগোরে, সন্ধ্যার পর বাইরেই বাইর হইত না। এরমধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনে পাকিগুলার গুলিতে জুয়েলের তিনটা আঙ্গুল ভাইঙ্গা গেল, হাড় ভাইঙ্গা গুলি ওইপাশ দিয়া বাইর হইয়া গেল। দ্রুতই ব্যান্ডেজ করা হইছিল, কিন্তু ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট হয় নাই। ওরে ডাঃ আজিজুর রহমানের কাছে নিয়া যাওয়া হইল। ব্যান্ডেজটা খুইলা তো তিনি আঁতকাইয়া উঠলেন, আঙ্গুল তিনটা মনে হয় আর রাখা গেল না। ক্যামনে জানি জুয়েল ডাক্তারের মনের কথা পইড়া ফালাইল, মিনতি কইরা কইল,
--- দেশ স্বাধীন হইলে আমি ন্যাশনাল টিমের হইয়া ওপেনিংয়ে নামুম, ক্যাপ্টেন হমু। আঙ্গুল তিনটা রাইখেন স্যার, প্লিজ...
---“উনার আঙ্গুল তিনটা কি পরে ভালো হইছিল, বাবা? উনি কি ন্যাশনাল টিমের ওপেনার হইতে পারছিলেন?” প্রশ্নটা করতে গিয়ে গলাটা কেঁপে গেল ছেলেটার।
খুব ধীর পায়ে জানালার পাশে গিয়া দাঁড়ালেন বদিউল আলম, বুকের ভেতর থেকে যেন একরাশ হাহাকার বেরিয়ে এল, “জুয়েল প্রায় সময়ই হাসতে হাসতে বলত, পাকিস্তান তো ভাইঙ্গা দিতাছি, খালি স্বাধীন বাংলাদেশটা হইতে দে, দেখবি ক্যামনে পাইক্কাগুলারে হারাই। ওপেন করতে নাইমা পিটাইতে থাকুম, পিটাইতে পিটাইতে ছাল বাকলা তুইলা ফেলুম। শালার আঙ্গুল তিনটায় গুলি না লাগলেই আর সমস্যা হইত না। কবে যে ভালো হইব কচু, কবে যে ব্যাট ধরতে পারুম...
--- “উনার আঙ্গুলগুলো আর ভালো হয়নি, বাবা? উনি কি আর খেলতে পারেন নাই?” ছেলেটার গলাটা খুব ক্ষীণ শোনায়...
--- ২৯শে আগস্ট রাতে আজাদদের বড় মগবাজারের বাসায় অভিযান চালায় পাকিস্তানী সেনারা, তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আলবদর কর্মী কামরুজ্জামান। আহত জুয়েলের সাথে সেই রাতে ওই বাসায় ছিল কাজী কামাল, আজাদ, টগর, বাশার। সবাইকে এক লাইনে দাড় করিয়ে জিজ্ঞেস করছিল, হাতিয়ার কিধার হ্যায়, অউর মুক্তি কাহা হ্যায়? পাথর মুখে দাঁড়ায়ে ছিল সবাই, কেউ জবাব দেয় নাই। আরও উন্মত্ত হয়ে যায় পাকিস্তানী সেনারা। জুয়েলের হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা দেখে হঠাৎ ভাঙ্গা আঙ্গুলগুলো শক্ত করে চাইপা ধরে এক সেনা, মোচড়াতে থাকে, চিবায়ে চিবায়ে জিজ্ঞেস করে,হাতিয়ার কাঁহা হ্যায় বোল... জুয়েলের আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। হঠাৎ কাজী কামাল এক পাকি সার্জেন্টের অস্ত্র ছিনিয়ে পালায়ে যায়, ক্ষোভে অপমানে বাকিদের হাতকড়া পরিয়ে কুকুরের মতো মারতে মারতে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায় পাকি শুয়োরগুলা। প্রচণ্ড টর্চার করা হয় ওদের উপর, কিন্তু একটা কথাও বের করা যায় নাই। জুয়েলের ভাঙ্গা আঙ্গুলগুলো বারবার মুচড়াইছে ওরা, অবর্ণনীয় যন্ত্রনায় চিৎকার করে ওঠে ও, কিন্তু একটা কথাও বলে নাই, সামান্য তথ্যও দেয় নাই। সেপ্টেম্বরের চার তারিখে আলবদর কমান্ডার মতিউর রহমান নিজামির নির্দেশে এবং তত্বাবধানে মেরে ফেলা হয় ওদের, ক্র্যাক প্লাটুনের বীর যোদ্ধাদের লাশটা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় নাই...
বলতে বলতে গলা ধরে আসে বদিউল আলমের, পেছন থেকে বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কাঁদতে শুরু করে ছেলেটা। “ স্বাধীন বাংলাদেশ টিমে খেলার স্বপ্ন ছিল ওর, ওপেনিংয়ে ব্যাট করার স্বপ্ন ছিল। জুয়েলের স্বপ্নটা কিভাবে হারায়ে যাইতে দেই বল? জুয়েলরে ক্যামনে হারায়ে যাইতে দেই?” ছেলের কাছে এর চেয়ে বেশি কৈফিয়ত দিতে পারেন না বাবা, অসম্ভব যন্ত্রণায় গলা বুজে আসে তার...
দৃশ্যপট- ২
বিশ্বকাপ ফাইনাল। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৯৯ সালের পর আর পাকিস্তানকে হারানো হয়নি, খুব কাছে গিয়েও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। তাই যদিও বা-ঙ-লা-দে-শ বা-ঙ-লা-দে-শ স্লোগানের ঢেউয়ে গ্যালারীতে কান পাতা দায়, তারপরেও বাংলাদেশের জয়ের সম্ভবনা নিয়ে কথা বলার মানুষ নাই বললেই চলে। আশা করবার মতো কোন উদাহরণই যে নাই নিকট অতীতে। তবে একজন মানুষ এখনো আশা ছাড়েন নাই। প্রচণ্ড অসুস্থ তিনি, ডাক্তার বলছে, সামান্যতম উত্তেজনাও ডেকে আনতে পারে বিপদ। কে শোনে কার কথা, স্টেডিয়ামে চলে এসেছেন ভদ্রলোক। আজ যে তার ছেলের অভিষেক। নিয়মিত ওপেনার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাধ্য হয়েই নতুন একজনকে সুযোগ দিতে হয়েছে। কিন্তু ফাইনাল ম্যাচের মতো এতো বড় পরিসরে মাত্র ২১ বছরের এক তরুনের অভিষেক ঘটাবার কোন ইচ্ছেই ছিল না বেশিরভাগ নির্বাচকের। কিন্তু প্রধান নির্বাচকের অনড় যুক্তি, এই ছেলের খেলা আমি দেখছি, পুরাই বাঘের বাচ্চা। আমি ওর উপর বাজি ধরতে চাই। অনেক অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ই তো খেলল, পাকিস্তানরে তো হারাইতে পারলাম না। দেখি না ওরে খেলায়া কি হয়...
ব্যাট হাতে মাঠে নামতেছে বাংলাদেশ দলে ওপেনার আবদুল হালিম খান, ডাকনাম জুয়েল। ওকে নামতে দেখে গ্যালারীর এক কোনায় বসে থাকা মানুষটার চোখ হঠাৎ ভিজে গেল। অনেক অনেকদিন আগে জুয়েল নামে আরেকটা ছেলেও ঠিক এইভাবে ব্যাট হাতে ওপেনিংয়ে নামতে চাইছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ দলের ওপেনার হয়ে। আকাশে দিকে তাকায়ে বোধহয় সেই হাসিখুশি ছেলেটাকে খুঁজলেন বদিউল আলম, গর্ব আর আনন্দের এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে, আপনমনে বললেন, দেখ জুয়েল, আমি তোর স্বপ্নকে হারাইতে দেই নাই, তোকে হারাইতে দেই নাই...
ঠিক তখনই আম্পায়ার ঘোষণা ক্রলেন, “প্লে” । উমর গুলের প্রথম বল, অফ স্ট্যাম্পের একটু বাইরে, অসাধারন কনফিডেন্সের সাথে কাভার ড্রাইভ করল অভিষিক্ত ব্যাটসম্যান। ধারাভাষ্যকারের গলায় বিস্ময়, হোয়াট আ শট... হোয়াট আ টাইমিং!! নিজের শারীরিক অবস্থার কথা খেয়ালই থাকলো না বদিউল আলমের, আনন্দে লাফ দিয়ে উঠলেন, উচ্ছ্বাসিত হলেন বাচ্চা শিশুর মতো। পরের বল, এবার একটু শর্ট, ব্যাটটাকে ধরে কচু কাটা করার মতো করে পুল করল ব্যাটসম্যান, তিনটা ফিল্ডারের মাঝখান দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে বল সীমানার বাইরে। আউটস্ট্যান্ডিং প্লেসমেন্ট, ওয়াও, ধারাভাষ্যকার পারলে এখনই মাঠে নেমে যান।
তারপরের এক ঘণ্টা স্রেফ টর্নেডো বয়ে গেল মাঠে, নাকের জল-চোখের জল এক হয়ে সরিষা ক্ষেত দেখতে শুরু করল পাকিস্তানী বোলাররা। বদিউল আলম ফিরে গেলেন সেই সময়ে, সেই কাভার ড্রাইভ, সেই স্লগ সুইপ, সেই লফটেড শট। ২৪ তম ওভারের শেষ বলে যখন আউট হল জুয়েল, পাকিরা উৎসব করতে ভুলে গেল। মাইরের চোটে এমনি তব্দা লাইগা গেছে ওদের যে, বিশ্বাসই করতে পারতেছে না জুয়েল আউট হইছে। দলের রান তখন ১৮২, জুয়েলের নামের পাশে জ্বলজ্বল করতেছে ১২১ রানের ইনিংস। মাথা উঁচু করে দর্শকের অবিশ্রান্ত করতালির মধ্যে দিয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে গেল ছেলেটা, মুখে এক টুকরো হাসি লেগে আছে, সেই পুরনো অমলিন এক টুকরো হাসি।
বেশ কয়েক ঘণ্টা পর। পাকিস্তান ৩২৭ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে নেমেছে। মাশরাফির প্রথম ওভারেই দুই উইকেট পড়ে গেল পাকিস্তানের, প্রথম স্পেলে গেল চারটা। খাবি খেতে থাকা পাকিস্তানের ইনিংসে হাল ধরল মিসবাহ উল হোক আর সরফরাজ আলী। মাত্র ২৫ ওভারে ২১৩ রানের পার্টনারশিপ গড়ে ম্যাচটা যখন প্রায় বের করে নিয়ে যাচ্ছে ওরা দুইজন, তখনই সেকেন্ড স্পেলে মাশরাফি নিজেই বোলিংয়ে আসলো। কিন্তু নাহ, মিসবাহকে কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে প্রায় সবাই মার খেয়েছে, সবচেয়ে বেশি ঝড়টা গেছে সাকিবের উপর। জুয়েলের সেই বিস্ফোরক ইনিংসের পর ধস নেমেছিল, কিন্তু এক প্রান্তে সাকিবের অপরাজিত ৮১ রানেই বাংলাদেশ ৩২৬ রানের পুজি দাঁড় করাতে পেরেছিল। বাট বোলিংয়ে প্রথম স্পেলে সেই ধারটা ধরে রাখা যায় নাই, কিন্তু মাশরাফি সাকিবের উপরেই ভরসা রাখল। ৪২ নাম্বার ওভারটা করতে আসলো সাকিব, আর প্রথম বলেই বুঝায়া দিল কেন তাকে এই গ্রহের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার বলা হয়। ২৪৭ রানে পাকিস্তানের ষষ্ঠ উইকেট পড়ল, ক্রমেই ম্যাচ বের করে নিতে থাকা মিসবাহ ৯৭ রানে সাকিবের অসাধারন এক আর্মারে বোল্ড হয়ে গেল। সেই ওভারের ৪র্থ বলে সরফরাজ এবং শেষবলে সাইদ আজমলকে ফিরিয়ে দিয়ে ম্যাচ বাংলাদেশের আয়ত্বে নিয়ে এল সাকিব। স্বীকৃত ব্যাটসম্যান বলতে কেবল শহীদ আফ্রিদী ছাড়া আর কেউ নেই ক্রিজে।
দলের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে চোখ বন্ধ করে ছয় মারতে গিয়ে আউট হয়ে যায় বলে বিশেষ বদনাম আছে আফ্রিদির। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে ম্যাচ তার কাছে পুরোপুরি ভিন্ন একটা ব্যাপার, বাংলাদেশের সাথে হিসাবটা পাকিস্তানের বরাবরই পুরনো। তাই এইটা স্রেফ একটা ম্যাচ না, এইতা আরও অনেক কিছু। একাত্তরে কানে ধরে নাকে খত দিতে হইছিল এই বাঙ্গালীদের সামনে, ৯৯ য়ের বিশ্বকাপে সেই লজ্জার সে নিজেই একটা অংশ। সুতরাং একজন পাকিস্তানি হয়ে আরেকবার এই মছুয়া বাঙালিদের কাছে হারবে সে? কিভাবে সহ্য হবে তার?
তাই ডাকবিশেষজ্ঞ আফ্রিদি হঠাৎ করেই অতিমানব হয়ে উঠলো। একের পর এক বল আছড়ে পড়তে থাকলো সীমানার বাইরে। রিকোয়ার্ড রানরেট যতই কমতে লাগলো, গ্যালারীতে কিছু শুয়োরশাবকের আফ্রিদি আফ্রিদি চিৎকার ততই প্রকট হয়ে বাজতে লাগলো কানে।
বদিউল আলম তাকিয়ে আছেন । শুন্য দৃষ্টি। এক পাশে বিশাল স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে, পাকিস্তান নিড এনাদার ফরটিন রান ফ্রম সিক্স বলস, ওয়ান উইকেট ইন হ্যান্ড। ছুটে আসছে মাশরাফি, লাস্ট ওভারের প্রথম বল। অসাধারন আউট সুইঙ্গার, চোখ বন্ধ করে মারায় বল ব্যাটের ধারেকাছেও এল না। ২য় বলটাও স্ট্যাম্পের উপর ছিল, এবারও তেড়েফুঁড়ে হাঁকাতে গেল আফ্রিদি, এবারও মিস। চার বলে ১৪। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষন নিজেকে বোঝাল , কি করছে সে? জীবনে তো অনেকবারই অন্ধের মত আউট হয়েছে, দলের প্রয়োজন ছুড়ে ফেলে এসেছে, আজকেও কি সে তাই করতে চাচ্ছে? মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে গেল সে, শান্ত দৃষ্টিতে মাশরাফিকে দৌড়ে আসতে দেখলো, তারপর ঠাণ্ডা মাথায় চমৎকার প্লেসমেন্টে বলটা নিয়ে ফেলল গ্যালারীতে। স্টেডিয়ামের হৃদপিণ্ডটা হঠাৎ যেন থমকে গেল। ৪র্থ বলটা ইয়র্কার দিতে চেয়েছিল মাশরাফি, লো ফুলটস হয়ে ব্যাটের সামনে পড়ল। আবারো ছয়। নিঃস্পন্দ হয়ে গেল হাজার হাজার মানুষ, হতভম্ব মাশরাফির হতাশাটা যন্ত্রণা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল মাঠের প্রতি ইঞ্চিতে, প্রতিটা মানুষের হৃদয়ে। শেষ দুই বলে দরকার দুই রান। তবে কি আজো হল না?
বদিউল আলম তাকিয়ে আছেন, কিন্তু কিছুই দেখছেন না। ভোতা একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে ভেতরে, এ যন্ত্রণার কোন সীমা পরিসীমা নেই। ভাসাভাসা দেখতে পেলেন, ৫ম বলটা হল। মাশরাফির স্লোয়ার, প্রথমে পেসে বিভ্রান্ত হলেও শেষমেষ গায়ের সবটুকু জোর দিয়ে মেরেছিল আফ্রিদি, অনেক অনেক উপরে উঠেছে বল, গন্তব্য লং অফের সীমানা। তখনই হঠাৎ এক বিচিত্র দৃশ্য চোখে পড়লো আলম সাহেবের। মিড অফ থেকে উল্কার বেগে ছুটছে একটা ফিল্ডার, চোখ দুটো বলের দিকে। ছেলেটার নাম জুয়েল, আবদুল হালিম খান জুয়েল। ছেলেটা প্রানপনে দৌড়াচ্ছে, কানে ভেসে আসছে টুকরো টুকরো কথা, “দেশ স্বাধীন হইলে ন্যাশনাল টিমে খেলুম, ওপেনিংয়ে নামুম, ক্যাপ্টেন হমু। আঙ্গুল তিনটা রাইখেন স্যার, প্লীজ” হঠাৎ কেউ একজন চিৎকার করল, হাতিয়ার কাঁহা হ্যায় বৌল। মটমট শব্দ হল, তিনটা ভাঙ্গা আঙ্গুল কেউ একজন মোচরাচ্ছে, তীব্র আর্তচিৎকার, মাগো...
অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য দেখলো আফ্রিদি। মিড অফের ফিল্ডারটা দৌড়াতে দৌড়াতে সীমানার কাছে আচমকা এক লাফ দিল, মাটি থেকে অনেকটা উপরে, শিকারি ঈগলের মত হঠাৎ ডান হাতে ছোঁ মেরে লুফে নিল বলটা, তারপর পড়ে গেল, মাটিতে, সীমানার এ পাড়ে। তারপর হঠাৎ যেন আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটলো, একশোটা বজ্রপাত হল একসাথে, কয়েকশো কিলোমিটার বেগে সুনামি আছড়ে পড়লো উপকূলে। কিন্তু না, এসবের কিছুই স্টেডিয়ামে এরপরের মুহূর্তে সবকটা মানুষের অসামান্য আনন্দের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের স্রোতকে বোঝাতে পারবে না, ব্যাখ্যা করতে পারবে না এ অনির্বচনীয় অনুভূতিকে।
মাঠের সেই কোনায় অবশ্য তখন খুব বিচিত্র এক দৃশ্য দেখা গেল। জুয়েল নামের অভিষিক্ত সেই ছেলেটার হাতে তখনও সেই বলটা ধরা, তাকে বুকে নিয়ে কাঁদছেন বদিউল আলম। হাওমাও করে কাঁদছেন, বাবার কাঁধে মুখ গুঁজে হাওমাও করে কাঁদছে জুয়েলও। বাবার কাঁধে চড়ে বা-ঙ-লা-দে-শ বা-ঙ-লা-দে-শ স্লোগান দিচ্ছিল, হঠাৎ করেই ব্যাপারটা চোখে পড়ল ছোট্ট রুমির। বড়দের কাণ্ডকারখানা কখনই বুঝতে পারে না সে, এখনও বুঝলো না। এই অসম্ভব আনন্দের মুহূর্তে কেউ কাঁদে? অথচ দেখো তো, এই দুইটা মানুষ কি আকুল হয়ে কাঁদছে ... আশ্চর্য তো...
ছোট্ট রুমি আরেকটুঁ দূরে তাকালেই আরও আশ্চর্য একটা ব্যাপার দেখতে পেত। একটা রাজপুত্রের মত ফুটফুটে ছেলে, দুষ্টুমি ভরা হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকা মানুষ দুটোর দিকে। কিন্তু কি আশ্চর্য, সেও কাঁদছে, হাসতে হাসতেই কাঁদছে। তার চোখটাও ভেজা, লাল হয়ে গেছে... আসলেই বড়দের কাণ্ডকারখানা বোঝা বড্ড মুশকিল...
উৎসর্গ- যারা ভোর এনেছিল...

Courtesy: 
ডন মাইকেল করলেওনে

Wednesday, November 19, 2014

একজন সঞ্জীব চৌধুরী...

তখন বিএনপির দ্বিতীয় শাসন আমল। কারো মুখ খুলবার উপায় নাই। ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছে মানুষ, কেউ মুখ খুলতে পারেনা। বিদ্যুত নাই, মুখ খুলবার উপায় নাই।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের উপর চলছে অত্যাচার। পূর্নিমার কান্নার হাহাকার ভেসে যায় যমুনার জলে। পিতারা বলেন, বাবারা, একজন একজন করে আসো...
কিছু ছেলে, প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অকুতোভয় ছেলে আয়োজন করে এক কনসার্টের। ছেলেগুলি গেঞ্জি প্রিন্ট করে। নাম দেয় কনসার্ট ফর ফাইটার্স। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে, হৃৎপিন্ডস্বরূপ রাজু ভাস্কর্যে। কোন স্পন্সর নেই। ছেলেরা নিজেরাই টাকা তুলে আয়োজন করে। পুলিশি হুমকি কনসার্ট বন্ধ করে দেবার। কোন গায়ক রাজি হন না গান গাইতে।
এগিয়ে এলেন একজন মানুষ। একজন গায়ক। সঞ্জীব চৌধুরী তাঁর নাম। ঝাঁকড়া বাবরি দোলানো চুলে তিনি মাইক্রোফোন হাতে উঠে দাঁড়ান। শুরু করেন গান। চারদিকে পুলিশ ঘিরে রয়েছে। বিএনপি সরকারের পুলিশ।
গান শুরু হলো। চলছে গিটার, চলছে তবলা। আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই... জড়ো হয় মানুষ, জড়ো হয় শিক্ষার্থীরা। ভরে ওঠে চত্বর।
সঞ্জীব চৌধুরী বলে ওঠেন, এবার আমি বক্তৃতা দেবো। চলছে গিটার, চলছে তবলা। উনি বলেন, "বাংলা ভাই হাঁটে। বাংলা ভাইকে কেউ ধরেনা। আমি যখন বলি, তখন আমাকে ধরে। আমি বলতে চেয়েছিলাম সেই সমস্ত কথা। আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্যত রাইফেল, আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্যত বেয়নেট!"
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই...
অন্ধকার নেমে আসে, অন্ধকার নেমে আসে সারা বাংলাদেশ জুড়ে। য়ার সেই অন্ধকারের ভেতর একজন তাজুল ইসলামকে খুন করা হয়। জানেন, তাজুল ইসলাম কে? ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনোমিক্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে কখনো চাকরী নেন নাই। তিনি ছিলেন আদমজীতে। তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো। উপপ্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন? আপনাদের কি মনে আছে? নাম বলেন!
মওদুদ আহমেদ! তিনি এখন আইনমন্ত্রী। ঐ ভালো আইন জানেন। জসীমউদ্দীনের মেয়ের জামাই। ভুলে গেছেন সবকিছু? সেই মউদুদ আহমেদ আমাদের আইন শেখায়। আপনারা এখানে বসে বসে আইন শিখবেন। একজন তাজুল ইসলামকে পিটিয়ে মারা হয়, খুন করা হয়। সাক্ষী আদমজী। একজন ভালো মানুষ মাঝরাতে বাড়ি ফিরে এলোনা।
আমি বলতে চেয়েছিলাম সে সমস্ত কথা। তখনই আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্যত রাইফেল। কোথায় আমার বন্ধুরা?
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই...
আমাদের আইনমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীতে শান্তি রক্ষিত হোক। বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীকে ধরিয়ে দিন! আমাকে চুপ করতে হয়, আমাকে চুপ করিয়ে দেয়া হয়।
আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই...
একটা ছেঁড়া ছুটকেস থেকে, একটা ছেঁড়া ছুটকেস থেকে ডান্ডি ডাইং হয়ে যায়! বিবেক কি বলে? আপনার বিবেক কি বলে? একটা ছেঁড়া ছুটকেস থেকে ডান্ডি ডাইং হয়ে যায়! বলেন! বলেন!
আরেকজন কর্নেল তাহেরকে বন্দী করা হয়। কে করছিলো? কে করছিলো কর্ণেল তাহেরকে বন্দী? বলেন! চিৎকার করে বলেন। বিবেক দিয়া বলেন। নিজের মায়ের নামে শপথ, নিজের মাটির নামে শপথ, বলেন। বলেন! এই মানুষটিকে কে খুন করছিলো? বলেন!
যদি না বলতে পারেন, আমি গান না গেয়ে এখান থেকে চলে যাবো... বলেন, আমি শুনতে পাই না।
( দর্শকদের ভেতর থেকে চিৎকার ওঠে, জিয়াআআআ, জিয়াআআআ! )
নামটা আবার বলেন!
( সমস্বরে চিৎকার, জিয়াআআআআআআআআআআ )
তাঁদেরকে শোনান, আমার পুলিশ ভাইদেরকে শোনান।
(পুলিশের উদ্দেশ্যে দর্শকদের চিৎকার, জিয়াআআআআ )
আরেকজন কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। আরেকজন বসুনিয়া, অই, অইইই জায়গায়, মুখ থুবড়ে পড়ে যান। আমি কি মিছা কথা কইছি ভাইজান? আমি কি কোন মিছা কথা কইলাম? বলেন? সাক্ষী আমরা সবাই... আমি তো ঐ কথাই কইতে চাইছিলাম...
তখনই, আমার দিকে এগিয়ে আসে উদ্যত বেয়নেট, আমার দিকে এগিয়ে আসে রাইফেল। আমি নাকি বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী। সো, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি বলেন? বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীকে ধরিয়ে দিন। আমি নাকি বিশৃংখলাসৃষ্টিকারী!
পৃথিবীতে শান্তি রক্ষিত হোক। আকাশে শান্তি, বাতাসে শান্তি।শান্তি রক্ষিত হোক...
তবু বন্ধুগন, আমার স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই, আমার অন্তরের কথা বলতে চাই।
[চারপাশে ঘিরে ছিলো বিএনপির পুলিশ]
______________________________________________________
আমাদের একজন সঞ্জীব চৌধুরীর বড় অভাব এই দেশে এখন। অনেক কথাই আমরা জানি, বলতে পারিনা। আমার দিকে ধেয়ে আসবে উদ্যত রাইফেল, উদ্যত বেয়নেট। গুম হয়ে যেতে পারি, এই ভয়ে বলতে পারিনা।
সঞ্জীবদা, আপনার সামনে আমি ছোট হয়ে যাই। আপনার সাহসের কাছে নিজেকে বড্ড ছোট মনে হয়। আমার অপারগতাকে ক্ষমা করবেন।
আমার, স্বপ্নেরই কথা বলতে চাই...

কৃতজ্ঞতাঃ Mahmudul Haque Munshi

https://www.youtube.com/watch?v=KOa6ov28fzQ